Thursday, March 22, 2012

সুলতানী আমলের শিলালিপির রূপ উন্মোচন


মোহাম্মদ আবদুর রহীম

শিলালিপি নিয়ে তেমন গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। মার্বেল পাথরের ওপর হরফ অঙ্কন এবং তা খোদাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকলেও প্রাচীন শিলালিপি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনি। একবার ঢাকার কেরানিগঞ্জের এক প্রাচীন মসজিদের কালো পাথরের(ব্লাক ব্যাসল্ট) ওপর লেখা কপি করার জন্য আমাকে দেয়া হয়েছিল। সেটা ছিল ফারসি লিপি। হুবহু কপি করার জন্য মধ্যযুগের ফারসি লিপি নিয়ে তখন আমি কিছুদিন আদাজল খেয়ে চর্চা করেছিলাম।

জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত যেসব শিলালিপি দেখেছি। তার অধিকাংশ কালোপাথরের। আর এসব পাথরে কিভাবে লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছে, লিপির শৈল্পিক মান, সমসাময়িক লিপিকার, খোদাইকার বিষয়ে কৌতুহল বেড়েছে। এবিষয়ে খোজখবর নিতে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উকি দিয়েছে মনে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাচীন শিলালিপির একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে চুরাশিটি ছবি ছিল। প্রদর্শনীর আয়োজক ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি প্রায় দুই শতাধিক শিলালিপি খুঁজে পেয়েছেন শুধুমাত্র ঢাকাতে। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য শিলালিপির সন্ধান মিলেছে। এর প্রায় সবগুলোই সুলতানী এবং মোগল আমলের। এত বিপুল সংখ্যক শিলালিপির লিপি হচ্ছে আরবি এবং ফারসি। আর এগুলো সবই ধর্মীয় ইমারতের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সুলতানি আমলের গুলো আরবিতে এবং মোগল আমলের গুলো ফারসিতে কেন লেখা হলো? এগুলো প্রায় সবই ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক। এখন যেমন নামফলক বাঙলা এবং ইংরেজিতে লেখা হয়। আমি ঢাকাতে জাপানি এবং চীনা মান্দারিন ভাষায়ও নামফলক করে দিয়েছি। আর আরবি, উর্দু, ফারসী এবং আরবি ক্যালিগ্রাফিতে হরদম করছি। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে যিনি নামফলকটি তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন, তার ইচ্ছে অনুযায়ী তা করা হয়। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে। যখন যে নামফলক লাগানো হয়, তা পড়ার লোকজনেরও তখন অভাব ছিল না।

নামফলক সমসাময়িক পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের জীবনমান ও শিল্পবোধের আয়না স্বরূপ। নামফলকের উপাদান যেমন- পাথর, বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন মানের ও দামের পাথর পাওয়া যায়। সাদা মার্বেল 'কারারা' সাধারণত লেখার কাজে বেশি ব্যবহার হয়। এটা পর্তুগাল ও ইতালি থেকে আসে। আর পাকিস্তান ও ভারত থেকেও মার্বেল আসে, তা নিম্নমানের। কিছুদিন পর সাদা পাথর লালচে রঙ ধারণ করে খোদাই নষ্ট হয়ে যায়। সাদা পাথরে সাধারণত হরফ খোদাই করা হয়।

কালো পাথর কদাচিত এখন লেখার কাজে ব্যবহার হয়। এটাতে লেখা সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য এবং খরচ বেশি। এতে হরফ খোদাই না করে জমিন খোদাই করা হয়। এজন্য দক্ষ ও নিপুন হাতের কারিগর ছাড়া তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।




গত ১৯ মার্চ ২০১২ দৈনিক সংগ্রাম ২১ পৃষ্ঠায় মুহাম্মাদ আবদুল কাদির-এর "বাবুবাজার জামে মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপির প্রাপ্ত অংশসহ লিপিটির পূর্ণ পাঠ উদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা" শিরনামে লেখাটি পড়ে এ ব্যাপারে আরো জানার আগ্রহ হল। বাবুবাজার জামে মসজিদের তৃতীয় তলায় রক্ষিত কালো পাথরটি সরজমিন দেখে মনে হল, পাঠোদ্ধার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর লিখন কৌশল, লিপির শৈলিমান এবং ততকালিন এই লিপিশিল্পের দক্ষতা ও নিপুনতা নিয়ে আলোচনাও গুরুত্বের দাবিদার।

আবদুল কাদিরকে ধন্যবাদ। তিনি যে "পাঠ" তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক বলে মনে করি। ক্যালিগ্রাফি বিদ্যায় আরবি লিপিতে তিনটি হরফ যথা-আলিফ, বা, নুন হচ্ছে মূল হরফ। অধিকাংশ হরফ এ তিনটি হরফের সমন্বয়ে গঠিত।
আলিফ হরফটি ত্বোয়া, যোয়া, কাফ এবং লাম হরফে আছে। এছাড়া লাম-আলিফ একত্রে লিখতে আলিফকে একটু হেলানো হয়। একে আলিফ মায়েলা বলে।





                                               মিলিয়ে দেখার জন্য লেখকের নিজের লেখা নমুনা


আবদুল কাদির তার লেখায় শিলালিপির দ্বিতীয় ছত্রে ফা হরফের আগে এগারোটি আলিফের কথা বলেছেন এবং সম্ভাব্য শব্দ উল্লেখ করেছেন। আমি একজন ক্যালিগ্রাফার হিসেবে তার উল্লেখকৃত শব্দ লিখে মিলিয়েছি এবং কম্পোজিশন নিয়মে তা হুবহু মিলে যায়। সুতরাং তার "পাঠ" ব্যাকরণগত এবং ক্যালিগ্রাফির নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ। এছাড়া তিনি ইতিহাস এবং পাঠোদ্ধার বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন। তা নবীন গবেষকদের কাজে লাগবে।

এই শিলালিপিটির একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটি বাঙলার স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহী বংশের একটা বিশেষ চিহ্ন বহন করে। আরবি ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি হচ্ছে সুলুস লিপি। একাদশ শতকে এ লিপি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পবিত্র কুরআনসহ সব ধরণের লেখায় অলঙ্করণের কাজে এলিপির  ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে।

নামফলকে আগে কুফি লিপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু সুলুস এসে তার স্থান দখল করে নেয়। তবে পাথরে খোদাই করতে গিয়ে দেখা যায় সুলুসের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকছে না। ক্যালিগ্রাফার আর খোদাইকারদের কাছে এসমস্যা বেশিদিন থাকেনি। সুলুস লিপিকে ভেঙে খোদাইকারের ছেনির ঘাত সহায়ক একটি নতুন লিপি উঠে আসে। তার নাম রাইহানী লিপি। তুর্ক আফগান ক্যালিগ্রাফার রাইহান এ লিপির আবিস্কারক। এটা সরল এবং গোলায়িত রেখার চমৎকার সমন্বিত একটি লিপি।

                                                                       বেঙ্গল তুগরা

 কিন্তু বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা এ লিপি দিয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তাদের পাললিক নমনিয়তা আর উল্লম্ব রেখার আশ্চর্য্য সম্মিলন ঘটিয়ে। বিশ্বব্যাপী সেই নতুন লিপির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস শাহী বংশের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা আবিস্কার করেন "বেঙ্গল তুগরা"। এই বেঙ্গল তুগরা সুদূর মিসরে সে সময়ের মামলুক সুলতানদেরও হৃদয় হরণ করেছিল। সুলতান হুসাইন বিন শাবান নিজেই বেঙ্গল তুগরা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করতে থাকেন।

                                                     সুলতান হুসাইন বিন শাবান-এর বেঙ্গল তুগরা

 বেঙ্গল তুগরার দিন শেষ হয়ে যায় মোগলদের চাপিয়ে দেয়া ফারসি লিপির আগ্রাসনে। শাসক বদল হয়। আরবির বদলে ফারসি রাজদরবার দখল করে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাঙলার গৌরব অস্তমিত হয়।

Friday, March 9, 2012

বাঙলা ক্যালিগ্রাফি : ভিন্ন এক শিল্প আলেখ্য

ব্লগারের প্রোফাইল ছবি





বাঙলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা এ ভাষার প্রথম পথচলা থেকে শুরু হয়েছে। শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে। প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে।



ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে। কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের। আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্রেডিশন দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন দু'একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শুণ্যের কোঠায়।



বাঙলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে। এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন, দুই. লিপিকলা।



বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক। তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে। এ ধারায় যারা কাজ করেছেন তারা প্রায় সবাই চারুকলার।



প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায়। তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্যদের মাঝে দেখা যায় না।



আর বাঙলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে।



হাতে লেখা সাইনবোর্ড ও দেয়াল লিখন :

এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না। দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাঙলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হত। হরফে আলোছায়া আর উচুনিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোয়া ছিল অসাধারণ। তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করত।



একুশে উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনারের আশেপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মান সম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত। চারুকলার ছাত্ররা বরারবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত। এখন আর সেই মান নেই।



এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া মহল্লায়ও বের করা হত। এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে। এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল। আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালবাসা দূরে থাক যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে।




 উল্টো চিত্র:

এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে। বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। পেইন্টিংয়ে হাশেমখান, কাইয়ুম চৌধুরী আর আবদুস সাত্তার বাঙলা হরফকে অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে।





অন্যদিকে বলা যায় একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ্য করা যায়।









এসব বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায়। তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোন ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাঙলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন।

আরহামের পিকটোগ্রাফি:



আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেচিয়ে বাকিয়ে যেকোন বস্তু বা প্রাণীর চিত্র একেছেন। তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে সাচ্ছন্দ্যরূপে। ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে। এধরণের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।

এই হচ্ছে চলমান বাঙলা ক্যালিগ্রাফির চিত্রালেখ্য।


ছবি- নেট ও আমার সংগ্রহশালা থেকে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিতে বাংলা সাহিত্য পরিষদের অবদান

 -মোহাম্মদ আবদুর রহীম 
 
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির পথচলা এবং এর প্রতিষ্ঠায় যেসব প্রতিষ্ঠান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, বাংলা সাহিত্য পরিষদ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

আমরা জানি, ক্যালিগ্রাফি একটি সুপ্রাচীন শিল্পমাধ্যম এবং হাজার বছর ধরে মুসলমানরা একে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সুলতানি আমল ও মোগল আমলের পর '৮০-এর দশকে এসে পুনরায় এ শিল্পটির চর্চা জোরে-শোরে শুরু হয়। প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং অল্প সময় পরে ক্যালিগ্রাফির সংগঠন গড়ে ওঠে। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।



 বাংলা সাহিত্য পরিষদ ক্যালিগ্রাফির লেখক এবং শিল্পী তৈরিতে প্রথম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৯০-এর দশকে রাজধানীর মগবাজার ডাক্তারের গলিতে সাহিত্য পরিষদ কার্যালয়ে আমরা কয়েকজন তরুণ আমাদের উস্তাদ আবদুল মান্নান সৈয়দের অমূল্য রত্নসম ক্লাসগুলোতে বুভুক্ষের মতো হাজির হতাম। সেই ক্লাসগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন এবং লেখালেখিতে প্রেরণা যোগায়। 

অবশ্য '৮০-এর দশক থেকে আমার ক্যালিগ্রাফিচর্চা শুরু। বাংলা সাহিত্য পরিষদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী এবং এর প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। শুধু সাহিত্য নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে শিল্পকলায় সম্পূর্ণ নতুন একটি পথ রচনায় এ প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখেছে। 

অবশ্য সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের অবদানও উল্লেখ্য। '৯০-এর দশকে আমাদের চোখে যে স্বপ্নের অঞ্জন মেখে দিয়েছিল সাহিত্য পরিষদ, আজ তা যৌবনে পদার্পণ করেছে। এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির প্রতিষ্ঠায় এবং পথচলায় নীরব সহায়তা দিয়েছে। এমনকি ক্যালিগ্রাফির লেখক তৈরিতে এর সাহিত্য সভা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা অনস্বীকার্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 আজ শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এবং দেশের জন্য সুনাম ও মর্যাদা বয়ে এনেছে, সে পরিপ্রেক্ষিত রচনায় এ প্রতিষ্ঠানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা যায়। দেশে একদল তরুণ সম্ভাবনাময় ক্যালিগ্রাফার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জায়গা হিসেবে সাহিত্য পরিষদ দীর্ঘ সময় ধরে সহায়তা প্রদান করেছে। 

প্রায় একযুগ বাংলা সাহিত্য পরিষদের মিলনায়তনে ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্যালিগ্রাফির প্রতি এ প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসা ও মমত্ববোধের পরিচয় হচ্ছে প্রশিক্ষণ ক্লাসের জন্য মিলনায়তনকে বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। 

বর্তমানে তরুণ ক্যালিগ্রাফিশিল্পীদের অধিকাংশই এ প্রশিক্ষণ ক্লাসের ফসল। বিখ্যাত উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারী ছাত্রদের ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির তালিম দিতেন এসব ক্লাসে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ক্যালিগ্রাফির ওয়ার্কশপ, সংবর্ধনা, সেমিনার প্রভৃতি অনুষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে বিনা ভাড়ায় করা সম্ভব হয়েছে।

প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী, ফেস্টিভ্যাল প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আমাদের ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন, অ্যাওয়ার্ড অর্জন এবং প্রশংসিত হচ্ছেন, তা বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির বড় ধরনের অগ্রগতি এবং উন্নয়নের প্রমাণ বহন করে। ইসলামী শিল্পকলার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ওআইসির কালচারাল বিভাগ ইরসিকা(IRCICA) আজ মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফিকে পুন:প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। খুশির খবর হচ্ছে, সেই কার্যক্রমের সাথে আমাদের ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। 

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির আজকের এই গৌরবময় অর্জন ও মর্যাদা লাভের পেছনে বাংলা সাহিত্য পরিষদের বড় ধরনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণকে পরিশীলিত ও রুচিবোধকে উন্নত করতে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, '৮০-এর দশকে এদেশে আমজনতার চিত্ত বিনোদনের জন্য যেসব প্রকাশনা, বিশেষ করে ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, ঘরের দেয়ালশোভিত করার চিত্রকর্ম বা ছবি প্রভৃতিতে সিনেমার নায়িকাদের চিত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত। 

আজ সেখানে ক্যালিগ্রাফি কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিগতভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উপহার হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে আমল দেয়া হচ্ছে। এমনকি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদ আত্মীয়-পরিজনের কাছে দেয়ার সময় মিষ্টির সাথে ক্যালিগ্রাফি পাঠানোর মত ঘটনা ঘটেছে। 

ক্যালিগ্রাফি একটি পরিবারকে যে ইসলামের সুশীতল পরিবেশ ও জীবনচর্চায় ফিরিয়ে আনতে পারে, সে কথাও আমরা জানতে পেরেছি। এই যে বিশাল পরিবর্তন এবং তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় বলে মনে করি। এটার পেছনে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলা সাহিত্য পরিষদের অবদান অবশ্যই রয়েছে। 

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির অগ্রযাত্রায় বাংলা সাহিত্য পরিষদ যে সহায়তা দিয়েছে, তার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন এবং ক্যালিগ্রাফির আজকের এই অবস্থান তৈরিতে সাহিত্য পরিষদের অকুন্ঠ অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

Wednesday, March 7, 2012

সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের দ্বিতীয় শিশু-কিশোর ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা : ক্যালিগ্রাফি চর্চাকারীরা সুন্দর মানুষে পরিণত হন











ন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও নবী (সা.) দিবস উপলক্ষে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত দ্বিতীয় শিশু-কিশোর ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, ক্যালিগ্রাফি একটি সুন্দর শিল্প। যারা এ শিল্পের চর্চা করেন তারা সুন্দর মনের মানুষে পরিণত হন। আমাদের উচিত আগামী প্রজন্মকে সুন্দরের সাধকে পরিণত করতে—এ শিল্পের চর্চা শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া।

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২, জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. আবদুর রবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শিল্পী ড. আবদুস সাত্তার। প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠা অধ্যক্ষ শিল্পী সবিহউল আলম, নয়াদিগন্তের শিল্প সম্পাদক হামিদুল ইসলাম ও শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক শিল্পী ইব্রাহীম মণ্ডল। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রের সেক্রেটারি কবি আসাদ বিন হাফিজ, সহকারী সেক্রেটারি শরীফ বায়জীদ মাহমুদ প্রমুখ।

প্রধান অতিথি ড. আবদুস সাত্তার বলেন, নবী করিম (সা.) ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের ভালোবাসতেন। তিনি এ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সভাপতির বক্তব্যে ড. আবদুর রব বলেন, মুসলমান শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি এবং আল্লাহর সৃষ্টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি এঁকে তাদের শিল্প দক্ষতার প্রমাণ করেছেন। অশ্লীল ও নগ্ন এবং জীবের ছবি আঁকা ছাড়াও যে শিল্প চর্চার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন সম্ভব।

শতাধিক শিশু-কিশোর এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। বিচারকদের চূড়ান্ত রায়ে বিজয়ীরা হলো : ক-গ্রুপে (শিশু শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী-বয়স অনূর্ধ্ব ১২)—প্রথম-ফয়জুর রহমান, আইডিয়াল ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী নূর ই জান্নাত হেরা, দ্বিতীয়-পশ্চিম শান্তিবাগ ইসলামিয়া মাদরাসার চতর্থ শ্রেণীর ছাত্র মাহমুদ হাসান মাশরুর, তৃতীয়- মানারাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়া ফাতিমা শরীফ। খ-গ্রুপে (৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী-বয়স অনূর্ধ্ব ১৭) প্রথম হয়েছে আইইএস স্কুলের নবম শ্রেণীর আবদুল কুদ্দুস, দ্বিতীয়-খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র মো. হাসান বিন ইব্রাহীম, তৃতীয়-তাহফিজুল কোরআন মাদরাসা দশম শ্রেণীর ছাত্র তারিকুল ইসলাম। বিজয়ীদের নগদ অর্থসহ আকর্ষণীয় পুরস্কার দেয়া হয়।

সাম্প্রতিক শিল্প ভাবনা




-মোহাম্মদ আবদুর রহীম

শিল্পকলা মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন বিষয়। মানুষ তার জৈবিক চাহিদা পূরণ আর মানসিক প্রশান্তি খুঁজতে নানা কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করেছে। জৈবিক প্রয়োজনে খাদ্য সংগ্রহ, বংশ বৃদ্ধি, কৃষিকাজ, শিকার কৌশল রপ্ত, পশু পালন, বাসস্থান নির্মাণ যেমন করেছে, কাজের অবসরে আনন্দ-ফূর্তির সাথে মানসিক প্রশান্তির জন্য কিছু একটা করার অনুভূতি তাকে আকুল করেছে। আত্মার এই আকুতি কখনো তাকে মহাশক্তির প্রতি লুটিয়ে পড়তে আবার কখনও অবাধ্য হতে প্রলুব্ধ করেছে।
শিল্পকলা তাই ধর্মাশ্রয়ী হয়ে টিকে থেকেছে অধিকাংশ সময়। এটা কখনো নিরপে ছিল না এবং এখনো নেই। সব শিল্পদর্শনের পেছনে শক্তিশালী হাতের ছায়া প্রত্যভাবে গোচরে না এলেও গবেষণায় তা প্রতিভাত হয়েছে।
শিল্পকলা সভ্যতার পরিচয় তুলে ধরে। কোন জাতির মানসিক অবস্থা জানতে বা পরিবর্তন করতে প্রাচীনকাল থেকে শিল্পকলা মোম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি ( Psyco-politics)- এর ইতিহাসে যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের কাছে, শিল্পকলার প্রধান দুটো দিক স্বর্গীয় আর্ট ( Divine Art) এবং উত্তেজক আর্ট ( Sensate Art) কিভাবে সভ্যতার পরতে পরতে উত্থান-পতনে ভূমিকা রেখেছে, তা পরিজ্ঞাত।
উত্তেজক আর্ট হচ্ছে শুধুমাত্র স্থুল চিন্তা-ভাবনা নির্ভর। যেভাবেই তা প্রকাশ করা হোক না কেন, মানুষের মধ্যে সেটা নীচ উপকরণ নিয়ে আলোচনা করে এবং অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়। সভ্যতার আভ্যন্তরিন মানসিকতায় একটা অলঙ্ঘনীয় নীচতাকে প্রকট করে তোলে। এর হিরোরা সাধারণত দেহপশারিনী অথবা সংশ্লিষ্ট মানসিকতায় আবদ্ধ, দুস্কৃতিকারী, ভণ্ড, প্রতারক এবং দুরাত্মা লোকেরা। ইন্দ্রিয় ভোগ-সম্ভোগের চেষ্টা করা, আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত রাখা, শ্রান্ত স্নায়ুমণ্ডলিকে উত্তেজিত করা, স্থুল আনন্দ-স্ফূর্তি, জৈবিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশন, অনৈতিকভাবে ব্যক্তিস্বার্থ আদায়, চরম সুবিধাভোগ এবং ইন্দ্রিয় আপ্যায়নই এর একমাত্র ল্য ও উদ্দেশ্য। পরিণামে জাতি-সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে প্ররোচিত করে এ আর্ট এবং এতে আকন্ঠ নিমজ্জিত জাতির ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়। সামাজিকভাবে একটি জাতি উচ্ছৃংখল, অনাচারে লিপ্ত হয়, মারাতœক ধরণের যৌনরোগের প্রসার এবং নিরপরাধ গরীব শ্রেণী গুটিকয়েক ধনীক শ্রেণীর গোলামে পরিণত এবং চরম নির্যাতনের শিকার হয়। উত্তেজক আর্টের কারিগর-পৃষ্ঠপোষকরা সব সময়ই মতার কাছাকাছি অবস্থান করে এবং জাতির উচু পর্যায়কে স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে জোর সহায়তা করে।
এই আর্ট যেখানে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে সৈসূর্য শিল্প তাকে অনুসরন করেছে এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিকোনকে আরো মজবুত করেছে। এটা ললিতকলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা ক্রমান্বয়ে বাহ্যিকভাবে চাকচিক্য ও তৈলমসৃণ করে কিন্তু অন্তসারশুন্য জাতিতে রুপান্তরিত হয়। মানুষকে তা বস্তুগত ও দৃশ্যমান অবয়বে আত্মলোভী প্রাণীতে পর্যবসিত করে। এ আর্টের শিকারে যে জাতি পড়ে তার কল্যাণময় উদ্দেশ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পূর্ণমাত্রার বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানসিকতায় চালিত হয়। এ আর্টের উত্তেজক আনন্দ ( Sensual Pleasure) শুধুমাত্র ইহজাগতিক তথা পৃথিবীকেন্দ্রিকতা, ধর্মনিরপেতা ও সুবিধাবাদী নীতিকে বরণ করে।
এ আর্টের কবলে পড়ে রোমান জাতি নগ্নমূর্তি চর্চায় ডুবে গিয়েছিল। অন্যদিকে বিশাল পরিমান জাতীয় সম্পদ অল্প সংখ্যক লোকের করায়ত্ত্ব হয়ে তা বিপুল সংখ্যক লোকের দারিদ্রের ওপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছিল। এই অসাম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রচেষ্টাকে অমানুষিক নির্যাতন দ্বারা দমন করা হয়েছিল। সেখানে ধর্মীয় ও নৈতিক বিধানের প্রতিটি ধারাকে লংঘন করা হয়েছিল। সে সমাজে যেখানেই মানুষ সততা, দয়ার্দ্রতা, বদান্যতা ও সহানুভূতির পথ অনুসরনের চেষ্টা করেছে, সেখানেই তারা ভোগ করেছে সীমাহীন নির্মমতা। নির্যাতনকারীরা নিজদেরকে গৌরবান্বিত বোধ করেছে, অহংকারের অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছে এবং নির্মমতার দীর্ঘ খড়গ অব্যাহত গতিতে চালিয়েছে। কিন্তু সেই জাঁকালো প্রাসাদ তাদের দ্রুত ভেঙ্গে পড়েছে। পুনরায় সেখানে মতা ও সম্পদের লোভ জাতিকে সেই দিকেই চালিত করেছে কারণ উত্তেজক আর্ট মানুষের মজ্জাগত বিষয় হিসেবে গৃহিত হয়েছে।
এই আর্ট পশ্চিমা বিশ্বসহ যেখানে আসন গেড়েছে , সেখানে ইন্দ্রিয় সুখ ও বৈষয়িক সুবিধা একাকীই আধুনিক মানুষের মনের ওপর একচ্ছত্র প্রভূত্ব স্থাপন করেছে আর তা লাভ করার জন্য সে কোন আইনের ধার ধারার প্রয়োজন বোধ করেনি।
এই আর্টের সহোদর হচ্ছে বর্তমান আধুনিক এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ( Abstract Art) । উত্তেজক আর্টের নিষ্পেষনে পশ্চিমা দুনিয়ায় মানুষ হাঁসফাস করছিল। রাশিয়ার ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ পর এ. কে গুস্তাফ এবং তার অনুসারীরা এক ধরণের বিমূর্ত শিল্পকলার উদ্ভাবন করেন। যাকে বলা হয় ‘কনস্ট্রাক্টিভ সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট’ বা গঠনমূলক প্রতিকধর্মী প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প। শিল্পকলার ইতিহাসে দেখা যায়, বর্তমানের বিমূর্ত শিল্পকলা ( Abstract Art) মূলত: রাশিয়ার প্রাথমিক বিপ্লবকালীন সময়ের ফসল হিসেবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। এ আর্টের যে তত্ত্ব নিহিত তা হচ্ছে- সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সিস্টেমের অভিন্নতা ও সংহতি চুর্ণবিচুর্ণ করার জন্য তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংহতি বিরোধী ভাবধারা ও উপকরণাদি প্রবিষ্ট করিয়ে দিতে হবে। এই তথাকথিত গঠনমূলক নীতির অনুসারী আর্টের ল্যই হচ্ছে প্রাচীন ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মূল্যমান ও সাংস্কৃতিক জীবনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করা।
আজ থেকে প্রায় পৌনে একশ বছর আগে রুশবিপ্লবের প্রাথমিককালে বলশেভিকদের দর্শনে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পেয়েছিল তা হচ্ছে- মেকানিক, কাব্য ও সঙ্গীত, যান্ত্রিক থিয়েটার, যান্ত্রিক প্রতিমূর্তি নির্মাণ এবং সবশেষে যান্ত্রিক মানুষ। আর্টের এই বিভিন্ন মাধ্যমে ( Media) ল্য ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমূহে বিপর্যয় সৃষ্টি করা। বলা বাহুল্য, এই আর্টের অগ্রনায়ক কান্দিনিস্কি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থার সদস্য ছিলেন। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তাকে মার্কিন মুলুকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি নিউইয়র্কে ‘মিউজিয়াম অব মডার্ণ আর্ট’ স্থাপন করেন। এ আর্টের সৌভাগ্য বলতে হবে কারণ কান্দিনিস্কি তার অনেক যোগ্য অনুসারী পেয়েছিলেন। হিটলার একসময় জার্মানি থেকে এ মতাদর্শের শিল্পীদের বহিস্কার করেছিলেন। তারা আমেরিকা গিয়ে আশ্রয় লাভ করেন। ফলে আমেরিকা এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। এভাবে এ আর্টের সাহায্যে মার্কিন জনগণের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় ( Personality Fragmentation) সৃষ্টির বীজ বপনে সাফল্য লাভ করার পর স্বয়ং রাশিয়া বর্তমানে বাস্তবাদী শিল্পে ( Realistic Art) ফিরে এসেছে।
একটা জাতি বা জনসমষ্টিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার অনেকগুলো পন্থা থাকতে পারে। মানবীয় মন ও মগজকে দাসত্বের নিগড়ে বন্দি করার পন্থাও হতে পারে বহুবিধ। কিন্তু মানব মনকে গোলামীর জিঞ্জির পরানোর আধুনিক উপায় হচ্ছে, তাদের সামনে এমন সব নিদর্শন উপস্থাপন করতে হবে আর তাদের চারপাশে এমন একটি দেয়াল তুলতে হবে, যার ফলে তারা বন্দি থেকেই নিয়ম-শৃংখলা পালনের গৌরব বোধ করতে পারে। তাই বর্তমান কালের বিজয়ীরা বিজিতদের সামনে অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন ও দুর্বোধ্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের নিদর্শন পেশ করা এবং তাতে তাদের মুগ্ধ বিমোহিত করে তুলতে পারাকেই যথেষ্ট মনে করে।
কোন একটি জাতিকে নৈরাশ্য হতাশাগ্রস্ত করে দেয়ার জন্য অর্থহীন ও ল্যহীন কর্মকাণ্ডে মশগুল করে দেয়া একটা অত্যন্ত শাণিত ও কার্যকর হাতিয়ার। অস্পষ্টতা এবং ল্যহীনতাই এই কাজকে সার্থক ও সচল করে দিতে পারে। একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে মানসিক অধ:পতনের নিম্নতম স্তরে পৌছে দেয়ার জন্যে রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব বিশারদরা যে কটি সাংস্কৃতিক উপায়-উপাদান প্রয়োগ করে থাকে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট সেগুলোর অন্যতম।
এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট মানবীয় আচরণের এমন পন্থা এবং বঞ্চনানুভূতি ও বিশ্লিষ্টতার এমন সব নিদর্শন উপস্থাপন করে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত হৃদয়াবেগ ও উচ্ছাস সব সুস্থতা ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
শিল্পের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বর্গীয় আর্ট ( Divine Art) যে প্রকাশভঙ্গী উপস্থাপন করে তাতে স্রষ্টার প্রকৃত ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী দৃশ্যমান হয়। সৃষ্টিরহস্যের কল্যাণময় উপাদান এতে প্রাধান্য পায়। এ আর্ট সযতনে নেতিবাচক, কুৎসিত, হৃদয় কলুষিত উপাদান ও অশ্লীলতা বর্জন করে। সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও মানসিক সুস্থতা এবং দৃঢ়তা এতে প্রাধান্য পায়। মানুষকে পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ আর্টে স্রষ্টার জয়গান তুলে ধরে। রঙ, রেখার রূপায়ণে স্বচ্ছতা, পবিত্রতা, নির্মল আনন্দ, সুক্ষ্ম হৃদয়াবেগকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। একে ধর্মীয় আর্ট বলে যে একপেশে মন্তব্য অপরপরা করে থাকেন। আসলে জনগণকে এর পূণ্যময় প্রভাব থেকে ফিরিয়ে রাখতেই তারা এ কুটকৌশল করে থাকেন।
এ আর্টের শক্তিশালী ও প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বিশেষকরে আরবি ক্যালিগ্রাফি সেই প্রাথমিক সময় থেকে যেভাবে উচুস্থান বজায় রেখে চলেছে, তাতে গবেষকগণ একে লিভিং আর্ট বলতে দ্বিধা করছেন না। একটি অতিসাধারণ উদাহরণে আমরা দেখতে পাবো এই আর্টের কল্যাণকর প্রভাব কত প্রবল। ধরা যাক, একটি করে দেয়ালে একটি নগ্ন শিল্পকর্ম ঝোলানো আছে। সেখানে কোন যুবক বা যুবতীর নির্জন শিল্পকর্ম দর্শনে কী অনুভূতি হবে? নপুংষক, বিবেক-বোধহীন কোন মানুষ এখানে শুধু শিল্প সৌন্দর্য দর্শনের কথা বলবেন। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের লিপি সম্বলিত চমৎকার একটি ক্যালিগ্রাফি শিল্প থাকলে ন্যুনতম তাতে পবিত্র ভাব না জাগলেও হঠাৎ খোদাভীতি জেগে উঠতে পারে এই ভেবে, যদি গযব এসে পড়ে! এখানেই এ আর্টের সার্থকতা।
শিল্পের ধারক-বাহকদের এই অতি সাধারণ বিষয়টির দিকে অনুভূতি ফিরে আসলে বাংলাদেশের শিল্পকলা তার কল্যাণময় উদ্দেশ্য ও ল্েয পৌছতে পারবে বলে আশা করা যায়।
লেখকঃ গ্রন্থকার, গবেষক, শিল্পী, ক্যালিগ্রাফার।

জাতীয় প্রেসক্লাবে বসেছিল শিশু-কিশোর ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের মিলনমেলা




গত ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বসেছিল শিশু-কিশোরদের মিলনমেলা। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র  আয়োজিত প্রথম জাতীয় শিশু-কিশোর ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা উপলক্ষে একঝাঁক মেধাবী শিশু-কিশোরের এ মিলনমেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আবদুর রব। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, অনেক কথার চেয়ে একটি সুন্দর শিল্পকর্ম বেশি শক্তিশালী। ক্যালিগ্রাফি শিল্পের এক চমৎকার মাধ্যম। এর মাধ্যমে শিল্পীরা সুন্দরভাবে অক্ষরকে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মুসলিম শিল্পীরা সেগুলোকে ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে কত সুন্দর  করে সাজিয়েছেন। ইসলামী  সংস্কৃতির একটি বড় মাধ্যম হিসেবে ক্যালিগ্রাফি আজ সারাবিশ্বের কাছে স্বীকৃত।
সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুরের সভাপতিত্বে কেন্দ্র আয়োজিত শিশু-কিশোর ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কবি আসাদ বিন হাফিজ , অধ্যক্ষ আশরাফ আল দীন, শিল্পী হামিদুল ইসলাম, শিল্পী শহিদুল্লাহ এফ বারী, শিল্পী ইব্রাহীম ম ল প্রমুখ । বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর আবদুস সাত্তার বলেন, বিশ্বের সর্বত্রই ক্যালিগ্রাফি চর্চা হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় শিল্পীরা শিল্পের এ শাখায় চর্চা করেছেন। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ শিল্প আরো জনপ্রিয় হবে।

সভাপতি তার বক্তব্যে বলেন, অংশ গ্রহণ করে যারা বিজয়ী হয়েছে শুধু তারাই নয় অংশ গ্রহণকারী সবাই এ আনন্দ আয়োজনের সমান অংশীদার। আগামীতে আরো বড় করে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে ইনশাআল্লাহ। এবারের প্রতিযোগিতায় ক- গ্রম্নপে প্রথম হয়েছে: মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের সুমাইয়া ফাতিমা শরীফ, ২য় হয়েছে ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মাসকুরা বিনতে মান্নান, ৩য় লিটল এনজেলস স্কুলের মুবাশ্বির রহমান স্বচ্ছ। খ- গ্রম্নপে প্রথম হয়েছে বিএএফ শাহীন কলেজের সাদিয়া নার্গিস, ২য় জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাম্মদ ইমরান হোসাইন, ৩য় আইইএস স্কুলের  মোঃ রাসেল আহমদ। বিজয়ীদের প্রত্যেককে নগদ অর্থ, ক্রেস্ট, বই ও সনদপত্র প্রদান করা হয়েছে। উভয় গ্রম্নপ থেকে কয়েকজনকে বিশেষ পুরস্কারও প্রদান করা হয়েছে।

Tuesday, March 6, 2012

ক্যালিগ্রাফির প্রেমে এলিনূর হল্যান্ড..


ব্লগারের প্রোফাইল ছবি






যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি নিরিবিলি শহরতলি। সেখানে মেয়েটির শৈশব কাটে এক রকম বৈচিত্রহীন পরিবেশে। টিনেজ বয়সটা রঙ আর স্বপ্নে বিভোর। পড়াশুনা করতে করতে তার শুধু মনে হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে।

এক সামারে তার সেই সুযোগ মিলে যায়।

এক তুর্কি পরিবারের আমন্ত্রণে সে ইস্তাম্বুল আসে। এখানে নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি আর একটি বিশেষ ধরণের আর্ট তাকে বিহ্বল করে তোলে। কিশোরী মনে তার দূরের স্বপ্ন জাগে। সে একজন ক্যালিগ্রাফার হবে। আরবি হরফের এই আর্টের প্রেমে সে দিওয়ানা হয়ে যায়। কিশোরীর প্রথম প্রেম বলে কথা!

ঘরে ফিরে কিছুই ভাল লাগে না। সারাদিন সে কালি আর খাগের কলম দিয়ে কাগজে হরফ একে চলে। তুরস্কে ক্ষণকাল আবাসে সে হরফগুলো আঁকা শিখেছিল। এরপর ক্যালিগ্রাফির টানে বহুবার তুরস্কে যেতে হয়েছে তাকে। সেই টিনেজ বয়সেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় সে।

ইসলাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন এলিনূর আয়েশা হল্যান্ড।



ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি তিনি টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিলিজিয়াস স্টাডিজে বিএ এবং পেনসিলভানিয়া ইউনিতে আরবিতে পড়াশুনা করেন। এছাড়া কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেন্টার ফর এরাবিক স্টাডিজে সামার প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন।



একটানা কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে ক্যালিগ্রাফির দীক্ষা নেন। মোহাম্মদ জাকারিয়া আর বাগদাদের উইস্সাম শাওকাত তার ওস্তাদদের অন্যতম।



এলিনূর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত আরবি ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম তিনি চর্চা ও প্রতিলিপি করা শুরু করেন। লাতিন হরফের ক্যালিগ্রাফিও এর সাথে আয়ত্ব করেন। বিশেষ করে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, উন্নয়ন, ক্রমধারা, প্রয়োগ এবং এর নিগুঢ় কলাকৌশল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।



১৯৯৪ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন জাদুঘরে, প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ক্লাস নেয়া শুরু করেন। খুব দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক-বাণিজ্যিক পর্যায়ে তার ক্যালিগ্রাফির সংগ্রহ বেড়ে যায়।



স্মিতোনিয়ান ইনস্টিটিউট, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি, ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ, নিউইয়র্ক সোসাইটি অব স্ক্রাইব ও লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় তিনি ক্যালিগ্রাফি প্রেজেন্টেশন এবং প্রদর্শনি করেছেন।

এছাড়া বৃটিশ মিউজিয়ামে তার ক্যালিগ্রাফি ওয়ার্কশপ শিল্পাঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির উপকন্ঠে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।



ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে তিনি বলেন, "এমন একটি চমৎকার নান্দনিক শিল্পকলা যে পৃথিবীতে রয়েছে, তা অনেকেই জানেন না। এমনকি এই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিই তাকে দূত হিসেবে অন্যান্য শিল্পকলার কাছে তুলে ধরেছে।"



সাধনা, অধ্যাবসায়, আর প্রগাঢ় শিল্পপ্রেমের এক জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আমরা এলিনূর আয়েশা হল্যান্ডকে দেখতে পাই। শিল্পাঙ্গনে তিনি উত্তর প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ছবি-নেট থেকে মারিং

Monday, March 5, 2012

ক্যালিগ্রাফি : নান্দনিকতার ভিন্ন মাত্রা....


ব্লগারের প্রোফাইল ছবি




বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি চর্চার বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পরিপূর্ণ ক্যালিগ্রাফি সেন্টারের প্রথম একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বিশেষকরে ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক দিক নিয়ে অধ্যয়ন এবং ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীর আয়োজন, ক্যালিগ্রাফি শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রথম একটি সামগ্রিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। এসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, একটি ভিন্ন মাত্রার শিল্পকলার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা।

ক্যালিগ্রাফি শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম আরো সৃজনশীল হতে পারে এজন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা। এতে শিশুদের সাথে বয়স্করাও ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।



গবেষকরা বলছেন, ইসলামী ক্যালিগ্রাফি আরবি লিপিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইসলাম পূর্ব সময়ে মক্কা নগরীতে আরবি লিপি প্রথম প্রচলন করেন বিশর ইবনে আবদুল মালিক আল কিন্দি। তিনি উত্তর আরবের হিরা এবং আনবার অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে নাবাতিয়ান লিপি লেখার শৈল্পিক জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাচীন তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, আরবরা ইসলামের আগে থেকেই আরবি লিপিতে লেখালেখি করত। এছাড়া সেময় ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাদের বইপত্র হিব্রু এবং সিরিয়াক লিপির সাথে আরবিতেও লিখত। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম থেকেই আরবি ক্যালিগ্রাফি বিশেষকরে হেজাজে শিল্পিত হয়ে উঠতে থাকে।

আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রসারের সাথে সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব পায় আরবি লিপি। পবিত্র কুরআন আরবিতে অবতীর্ণ হওয়ায় আরব-অনারব মুসলমানদের কাছে ইসলামের ভাষা হিসেবে আরবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুন্নাহ নথিভুক্ত ও সংরক্ষণের জন্য আরবি লিপির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান ও শিক্ষা লাভের জন্য মুসলমানরা আরবিতে পড়া ও লেখার বিষয়ে আগ্রহী। সুতরাং আরবি ক্যালিগ্রাফি খুব দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশ লাভ করেছে। আরবি ক্যালিগ্রাফি আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে অনারব দেশগুলোতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এটা এখন এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য দৃশ্যমান শিল্পকলার শীর্ষমানের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। গবেষকরা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে ’লিভিং আর্ট’ বা জীবন্ত শিল্পকলা বলে অবিহিত করছেন।

আরবি ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে লিপির ভেতর শৃঙ্খলা ও সুচারুবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তখন একে প্রশাসনিক কাজেই প্রধানত ব্যবহার করা হত। আরবি লিপি গোলায়িত অর্থাত টানা হাতের পেঁচানো লেখা এবং জ্যামিতিক স্বভাবের দুই বৈশিষ্ট্য নিয়ে উন্নতি লাভ করে। হরফ সঠিক আকার ও আকৃতিতে লেখার পদ্ধতি এবং হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন যাকে নোকতা বলে, তা তখনও বের হয়নি। হরফে হরফে, শব্দে শব্দে, বাক্য, যতি চিহ্ন প্রভৃতি ব্যবহারের বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট বিধি দেখা যায়নি। এবিষয়ে জনমনে দ্বিধা-দ্বন্ধ কাজ করত। বিশেষ করে অনারব বিশ্বে দ্রুত মুসলমাদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আরবি লিপির ভেতর এসব অসমঞ্জস্যতা দূর করার এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এপ্রেক্ষিতে নোকতা (হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন) এবং তাশকীল (স্বরচিহ্ন) পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেন আবুল আসওয়াদ আল দোয়ালী (মৃত্যু-৬৮৮ই.)। এরপর আল খলিল ইবনে আহমদ আল ফারাহিদী (মৃত্যু-৭৮৬ই.) আবুল আসওয়াদের তাশকীল পদ্ধতিকে পুণঃসংস্কার করেন। ১১ শতকের গোড়া থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং এতে ছয়টি স্বরচিহ্ন-কার হচ্ছে : ফাতাহ(আ-কার), দাম্মাহ(উ-কার), কাসরাহ(ই-কার), সুকুন(স্বরচিহ্ন মুক্ত চিহ্ন), সাদ্দাহ(দিত্ত্ব ব্যাঞ্জন বর্ণ চিহ্ন) এবং মাদ্দাহ(স্বরকে দীর্ঘকরণ চিহ্ন), এটা আলিফ প্রয়োগের মাধ্যমেও করা যায়।

উমাইয়া শাসন আমল হচ্ছে আরবি লিপির পরিবর্তনকালীন পর্যায়। কুফী লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করা এ সময় পেশায় পরিণত হয়। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি নতুন লিপির আবিস্কার করেন। তিনি এর নাম দেন মানসুব লিপি। উমাইয়াদের একটি স্মরণীয় কীর্তি হচ্ছে, জেরুসালেমে প্রাচীন আল কুদস নগরীতে মসজিদ আল আকসার পাশে কুব্বাতুস সাখরা(ডোম অব রক) মসজিদ নির্মাণ এবং তাতে ক্যালিগ্রাফির যুগান্তকরী প্রয়োগ।

এরপর আব্বাসীয় আমলে আরবি লিপি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও উন্নয়ন একই সাথে হতে থাকে।
পর পর তিনজন খলিফার উজির আবু আলী ইবনে মুকলাহ(মৃত্যু-৯৪০ই.) প্রথম আরবি লিপির আনুপাতিক লেখন পদ্ধতি আবিস্কার করেন কোন জ্যামিতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করেই। ইবনে মুকলাহ নাশখ(কপি করা) এবং সুলুস(এক তৃতীয়াংশ) লিপির আধুনিক আকার-আকৃতি রূপায়ন করেন। তিনি গোলায়িত টানা হাতের পেচাঁনো কুফি লিপির উদ্ভাবন করেন এবং তার উত্তরসূরী ইরাকী কুরআন বিশেষেজ্ঞ ক্যালিগ্রাফার আলী বিন হিলাল ইবনে আল বাওয়াব এ লিপির উন্নয়ন করেন।

ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক এবং শৈল্পিক প্রয়োগে চমৎকারিত্ব দেখান ফাতেমী খলিফাগণ। প্রাসাদ, মসজিদ, ও সিংহাসন সর্বত্র অঙ্গসজ্জা ও অলংকরণের কাজে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার শিল্পকর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। ক্যালিগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ক্যালিগ্রাফির বিভিন্ন ধারার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব রকম সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হয়।



ওসমানীয়দের মিসর দখলের প্রেক্ষাপটে তুর্কীরা নাশখ লিপিতে অসাধারণ শৈল্পিক সুষমা আনয়ন করে। কারণ তুর্কীরা আগে থেকে গ্রীক ও উর্দু হরফের হাতে লেখার সুক্ষ্ম সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ১৬ শতকের মধ্যভাগে হাফিজ ওসমান ও আহমদ কারাহিশারি নাশখ লিপিকে সৌন্দর্যের চুড়ান্ত মানে উন্নীত করেন। তুর্কীদের হাত ধরে আরবি ক্যালিগ্রাফি মধ্য এশিয়া, রাশিয়া, আফগানস্তিান এবং মোগলদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

মিসরে আরবি ক্যালিগ্রাফির উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় কাজ হচ্ছে পবিত্র কাবার গিলাফে স্বর্ণতন্তুতে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি। খেদিভ ইসমাইলের আমন্ত্রণে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ও নকশা শিল্পী আবদুল্লাহ বেক জুহদী মিসরে আগমন করেন। তিনি কাবার গিলাফ(কিসওয়াহ) বিশেষভাবে নকশা এবং সুলুস লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করেন। মিসরে ক্যালিগ্রাফি রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হিসেবে তাকে অভিহিত করা হয়। বাদশাহ ফাওয়াদের সময়ে ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনী করা হয়। বিখ্যাত তুর্কী ক্যালিগ্রাফার মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মিসরে অবস্থান করে আরবি ক্যালিগ্রাফির একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করেন এবং হরফকে স্বর্ণমণ্ডিত করার কৌশল প্রচলন করেন।
.


বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এবং সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র দশটি জাতীয় ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেছে। ক্যালিগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করছে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি। এছাড়া ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন, ক্যালিগ্রাফি একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ক্যালিগ্রাফির অঙ্গনে কাজ করে চলেছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা সুনাম অর্জন করে চলেছেন। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা হচ্ছে বিদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে । ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গবেষণাকর্ম প্রকাশিত ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা হচ্ছে।



তবে সামাজিকভাবে ক্যালিগ্রাফির একটি বড় ধরণের অর্জন হচ্ছে, ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ডে এর ব্যাপক ব্যবহার। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিফট আইটেম হিসেবে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম প্রদান বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি একটি নান্দনিক শিল্পকলা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।




ছবি- অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ।

Sunday, March 4, 2012

জাপানের ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি...



১৯৬৯ সালের ঘটনা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজের ছাত্র ছিলেন হোণ্ডা। তখন তার মনে হয়েছিল- "আমি কখনও আর একটি আরবি বই খুলব না। আরবি ভাষাকে আমি ঘৃনা করি। ঐ ভাষার অধ্যাপকদের দুই চোখে দেখতে পারি না। কারণ তারা শুধু আরবি ব্যাকরণ পড়ান আর আরবি উপন্যাস, যা পড়াটা ছিল এক প্রকার অসম্ভব কাজ।"

কিন্তু সৌদি আরবে তার প্রথম পাঁচ বছরের কর্ম জীবনে আরবি ভাষার চলিত এবং ঐতিহ্যিক ধরণ আর আরবি হরফের লাবণ্যময় প্রয়োগ দেখে তার শিক্ষাজীবনের পড়াশুনা তাকে আহত করে। হোণ্ডার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে থাকেন।

"প্রতিদিন আমি সুকে (বাজার) যেতাম আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম, দয়া করে একটু বলেন- এই জিনিসটার নাম কি? এভাবে জিজ্ঞাসা করতাম আর নামগুলো কাতাকানায় (জাপানি হরফ) লিখে ফেলতাম। আমার ধারণা, আমার শিক্ষকরা ছিলেন বোধশক্তির দিক দিয়ে সত্যিকারভাবে সাধারণমানের নাগরিকদের মত, যেমন- ড্রাইভার, কেরানি। তবু তারা ছিলেন টোকিও বিশ্বিবদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।"


হোণ্ডা খুব দ্রুত পেশায় উন্নতি করেন এবং সৌদি তেল মন্ত্রণালয়ের খনিজ-উৎস অনুসন্ধান দলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী তিন বছরের সিংহভাগ সময় তিনি মরুভূমিতে কাটান, যেখানে তিনি বেদুইনদের সাথে ঘনিষ্ট সময় অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেন।
" আমি প্রকৃতির পালাবদলের প্রতি খুব শ্পর্শকাতর হয়ে পড়ি।"



"যখন আমি দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের রুব আল খালি(শূন্য চতুর্থাংশ) এলাকা দেখলাম। মরুর চলমানতার সৌন্দর্য্য আমাকে অভিভূত করে তুলল। জীবন্ত কিছুর মত বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক প্রবাহ ছিল সেটা। আমার পদচিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মরুর দুরন্ত বাতাস সেখানে শিল্প ফুটিয়ে তুলেছে।"

"আমি মনে করি, আরবি ক্যালিগ্রাফির সাথে মরুর বালিয়াড়ির এই চলমান সৌন্দর্য্যের চমৎকার মিল রয়েছে। আরবি হরফের বৈশিষ্ট্যে শৈল্পিক চলমানতার বিষয়টি আমাকে এতটাই বিদ্ধ করেছিল যে, আমি যখন ফিরে আসি, আমার ভেতরে শুধু দুটো জিনিস আলোড়ন তুলছিল। এক. মরুর বালিয়াড়ির সৌন্দর্য্য আর দুই. আরবি ক্যালিগ্রাফি।


হোণ্ডা তার হৃদয়কে অস্বীকার করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে আবার তিনি আরব সংস্কৃতিতে ফিরে আসেন। ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একটি মুসলিম নাম ফুয়াদ(হৃদয়) রাখেন। আরবি ভাষা শিখেন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি শেখায় আত্ননিয়োগ করেন। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফির দৃশ্যপটে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হন।



জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে বেজির পশমের তুলি ফুদে(fude) ব্যবহার হয়। হোণ্ডা সেখানে বাশের কঞ্চির কলম (বুসে) ব্যবহার করে জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তার উদ্ভাবিত ধারার নাম- সোডো আরাবি।
shodo ‘arabi—“the way of Arabic writing.”



আরবি ক্যালিগ্রাফিতে "আল খত আল আরাবি" কয়েকটি বিশিষ্ট লিপিশৈলিকে বলা হয়। তেমনি জাপানি সোডো কথাটার অর্থ হচ্ছে- কানা(জাপানি হরফ) অথবা কানজি(চিনা হরফ) লিপিতে আঁকা বিশেষ ধরণের চিত্রলিপি।

বর্তমানে জাপানের সোডো মাস্টাররা(জাপানের ক্যালিগ্রাফির স্বীকৃত উস্তাদ) ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডাকে সোডো আরাবির জনক হিসেবে অবিহিত করেছেন।



১৯৯৯ সালে তিনি তুরস্কের উস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাচান চালাবির কাছ থেকে জালি দিওয়ানি(বলিষ্ঠ গোলায়িত আরবি লিপি) শৈলিতে ইযাযা(ডিপ্লোমা) অর্জন করেন। এবিষয়ে তিনি বলেন," আমরা প্রচলিত নীতিমালাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি না, যতক্ষণ না ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যিক রূপমাধুর্য্যকে আমরা উতরে যেতে পারছি।"



ইউকারি তাকাহাসি, ক্যালিগ্রাফির একজন ছাত্রী, ইয়ামাওকা(সাদা মার্বেল কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা) ও সোডো আরাবি শিখছেন

আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যাপারে জাপানীদের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কি? এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এবং ছাত্রদের কথা ছিল- সৌন্দর্য্য। এর পেছনে একটাই কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য্য। আমরা সৌন্দর্য্যে আপ্লুত হই।




টোকিওর আরাবিক ইসলামিক ইনস্টিটিউট

জাপানে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইনস্টিটিউট গড়া, সোডো আরাবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করা, জাপানি ক্যালিগ্রাফারদের মাঝে আলোড়ন তোলা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ অঙ্গনে জাপানি ছাত্রদের পুরস্কার অর্জনে যার অবদান একান্ত অনস্বীকার্য। তিনি ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডা। তার কীর্তি আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিতে অমর হয়ে থাকবে।

ছবি - নেট থেকে মারিং

মোহাম্মদ জাকারিয়া : ক্যালিগ্রাফি যার প্রেম....




এই ডাকটিকেটটি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ প্রকাশ করে। মুসলমানদের ঈদ উৎসব উপলক্ষে ঈদ মুবারক কথাটা আরবি ক্যালিগ্রাফির সুলুস শৈলিতে নকশা করেন আমেরিকার একজন জনপ্রিয় ক্যালিগ্রাফার।

তার নাম মোহাম্মদ জাকারিয়া (Mohamed Zakariya) (আরবিতে- محمد زكريا‎)। তিনি ১৯৪২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনচুরায় জন্মগ্রহণ করেন।


Mohamed Zakariya is a master of Arabic calligraphy. He was born in 1942 in California and trained as an aerospace engineer. In 1961, at the age of 19, a holiday to Morocco changed his life and career. He was fascinated by the culture, religion and language. Zakariya returned to Southern California, and began to learn the Arabic language and to study Islamic calligraphy. He later converted to Islam


বর্তমান সময়ে বিশ্বখ্যাত ক্যালিগ্রাফারদের অন্যতম মোহাম্মদ জাকারিয়া। জীবনের প্রথমদিকে এ্যারোস্পেস প্রকৌশলী হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও ১৯ বছর বয়সে তার জীবনে মোড় ঘুরে যায়। এ সময় এক ছুটিতে তিনি মরক্কো বেড়াতে আসেন। তার ভেতরে ছিল শিল্পসত্ত্বা, তিনি মরক্কো এসে আরবি ক্যালিগ্রাফি দেখে এতটাই অভিভূত হন যে, এটার প্রেম তার জীবন এবং পেশাকে বদলে দেয়। আরব সংস্কৃতি, ইসলাম এবং আরবি ভাষা তাকে বিমুগ্ধ করে তোলে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে তিনি আরবি ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং ইসলামি ক্যালিগ্রাফি হাতে-কলমে আয়ত্ব করা শুরু করেন।

পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।



ক্যালিগ্রাফির প্রতি তার প্রেম আর অধ্যাবসায় এতটা গভীরতা লাভ করে যে, এই শিল্পকলার তত্ত্বীয় ও প্রয়োগিক জ্ঞান লাভের জন্য মরক্কো, স্পেন, ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও তুরস্কের ইসলামি আর্ট, ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রে গমণ করেন।

ওয়াশিংটন ডিসির ফ্রির গ্যালারির ইসলামিক আর্টের কিউরেটরের পরামর্শক্রমে তুরস্কে গিয়ে তিনি ক্যালিগ্রাফির দীক্ষা নেন। ১৯৮৮ সালে তুরস্কে বতর্মান ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি উস্তাদ হাসান চালাবির নিকট ক্যালিগ্রাফি শেখা শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে চালাবি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুলুসনাশখ শৈলির মাস্টার ক্যালিগ্রাফারের সনদ 'ইকাজেট' প্রদান করেন। ক্যালিগ্রাফির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ এ্যাডভ্যান্স ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।

তিনি তুরস্কের আরেক বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ড. আলি আল্পসারানের কাছ থেকে তালিক শৈলিতে ইকাজেট লাভ করেন।

১৯৭২ সাল থেকে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাস শুরু করেন। এরপর তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তার ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের প্রদর্শনি এবং এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন।




তিনি ১৯৮৭ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় জালি সুলুস শৈলীতে একটি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ৩য় প্রতিযোগিতায় তিনি একই শৈলীতে ইনসেনটিভ পুরস্কার লাভ করেন। একমাত্র মার্কিন মুসলিম নাগরিক হিসেবে ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ডিপ্লোমা “ইযাজেত” অর্জন করেন। তিনি আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ওপর শিক্ষা প্রদান করেন।

ক্যালিগ্রাফির ওপর লেখা তার দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বই দু’টির নাম হচ্ছে, দ্যা আর্ট এবং অবজার্ভেশনস অন ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি



২০০২ সালে তার নির্মিত ডকুমেন্টরি "Muhammad: Legacy of a Prophet" (2002) প্রচারিত হয়।




তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামি ক্যালিগ্রাফির বিশিষ্ট দূত হিসেবে বিবেচিত।


জাকারিয়ার একটি বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি।


ক্যালিগ্রাফিটি সুলুস শৈলিতে করা হয়েছে। আরবি টেক্সট হচ্ছে- আলাইসাল্লাহু বিকাফিন আবদুহ। অর্থ- আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?

আপনারা চাইলে জাকারিয়ায় ওপর একটি চমৎকার ডকুমেন্টরি দেখতে পারেন-





http://www.youtube.com/watch?v=nshXFQ360wI&noredirect=1



ছবি- নেট থেকে মারিং