Thursday, March 22, 2012

সুলতানী আমলের শিলালিপির রূপ উন্মোচন


মোহাম্মদ আবদুর রহীম

শিলালিপি নিয়ে তেমন গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। মার্বেল পাথরের ওপর হরফ অঙ্কন এবং তা খোদাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকলেও প্রাচীন শিলালিপি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনি। একবার ঢাকার কেরানিগঞ্জের এক প্রাচীন মসজিদের কালো পাথরের(ব্লাক ব্যাসল্ট) ওপর লেখা কপি করার জন্য আমাকে দেয়া হয়েছিল। সেটা ছিল ফারসি লিপি। হুবহু কপি করার জন্য মধ্যযুগের ফারসি লিপি নিয়ে তখন আমি কিছুদিন আদাজল খেয়ে চর্চা করেছিলাম।

জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত যেসব শিলালিপি দেখেছি। তার অধিকাংশ কালোপাথরের। আর এসব পাথরে কিভাবে লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছে, লিপির শৈল্পিক মান, সমসাময়িক লিপিকার, খোদাইকার বিষয়ে কৌতুহল বেড়েছে। এবিষয়ে খোজখবর নিতে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উকি দিয়েছে মনে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাচীন শিলালিপির একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে চুরাশিটি ছবি ছিল। প্রদর্শনীর আয়োজক ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি প্রায় দুই শতাধিক শিলালিপি খুঁজে পেয়েছেন শুধুমাত্র ঢাকাতে। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য শিলালিপির সন্ধান মিলেছে। এর প্রায় সবগুলোই সুলতানী এবং মোগল আমলের। এত বিপুল সংখ্যক শিলালিপির লিপি হচ্ছে আরবি এবং ফারসি। আর এগুলো সবই ধর্মীয় ইমারতের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সুলতানি আমলের গুলো আরবিতে এবং মোগল আমলের গুলো ফারসিতে কেন লেখা হলো? এগুলো প্রায় সবই ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক। এখন যেমন নামফলক বাঙলা এবং ইংরেজিতে লেখা হয়। আমি ঢাকাতে জাপানি এবং চীনা মান্দারিন ভাষায়ও নামফলক করে দিয়েছি। আর আরবি, উর্দু, ফারসী এবং আরবি ক্যালিগ্রাফিতে হরদম করছি। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে যিনি নামফলকটি তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন, তার ইচ্ছে অনুযায়ী তা করা হয়। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে। যখন যে নামফলক লাগানো হয়, তা পড়ার লোকজনেরও তখন অভাব ছিল না।

নামফলক সমসাময়িক পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের জীবনমান ও শিল্পবোধের আয়না স্বরূপ। নামফলকের উপাদান যেমন- পাথর, বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন মানের ও দামের পাথর পাওয়া যায়। সাদা মার্বেল 'কারারা' সাধারণত লেখার কাজে বেশি ব্যবহার হয়। এটা পর্তুগাল ও ইতালি থেকে আসে। আর পাকিস্তান ও ভারত থেকেও মার্বেল আসে, তা নিম্নমানের। কিছুদিন পর সাদা পাথর লালচে রঙ ধারণ করে খোদাই নষ্ট হয়ে যায়। সাদা পাথরে সাধারণত হরফ খোদাই করা হয়।

কালো পাথর কদাচিত এখন লেখার কাজে ব্যবহার হয়। এটাতে লেখা সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য এবং খরচ বেশি। এতে হরফ খোদাই না করে জমিন খোদাই করা হয়। এজন্য দক্ষ ও নিপুন হাতের কারিগর ছাড়া তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।




গত ১৯ মার্চ ২০১২ দৈনিক সংগ্রাম ২১ পৃষ্ঠায় মুহাম্মাদ আবদুল কাদির-এর "বাবুবাজার জামে মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপির প্রাপ্ত অংশসহ লিপিটির পূর্ণ পাঠ উদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা" শিরনামে লেখাটি পড়ে এ ব্যাপারে আরো জানার আগ্রহ হল। বাবুবাজার জামে মসজিদের তৃতীয় তলায় রক্ষিত কালো পাথরটি সরজমিন দেখে মনে হল, পাঠোদ্ধার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর লিখন কৌশল, লিপির শৈলিমান এবং ততকালিন এই লিপিশিল্পের দক্ষতা ও নিপুনতা নিয়ে আলোচনাও গুরুত্বের দাবিদার।

আবদুল কাদিরকে ধন্যবাদ। তিনি যে "পাঠ" তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক বলে মনে করি। ক্যালিগ্রাফি বিদ্যায় আরবি লিপিতে তিনটি হরফ যথা-আলিফ, বা, নুন হচ্ছে মূল হরফ। অধিকাংশ হরফ এ তিনটি হরফের সমন্বয়ে গঠিত।
আলিফ হরফটি ত্বোয়া, যোয়া, কাফ এবং লাম হরফে আছে। এছাড়া লাম-আলিফ একত্রে লিখতে আলিফকে একটু হেলানো হয়। একে আলিফ মায়েলা বলে।





                                               মিলিয়ে দেখার জন্য লেখকের নিজের লেখা নমুনা


আবদুল কাদির তার লেখায় শিলালিপির দ্বিতীয় ছত্রে ফা হরফের আগে এগারোটি আলিফের কথা বলেছেন এবং সম্ভাব্য শব্দ উল্লেখ করেছেন। আমি একজন ক্যালিগ্রাফার হিসেবে তার উল্লেখকৃত শব্দ লিখে মিলিয়েছি এবং কম্পোজিশন নিয়মে তা হুবহু মিলে যায়। সুতরাং তার "পাঠ" ব্যাকরণগত এবং ক্যালিগ্রাফির নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ। এছাড়া তিনি ইতিহাস এবং পাঠোদ্ধার বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন। তা নবীন গবেষকদের কাজে লাগবে।

এই শিলালিপিটির একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটি বাঙলার স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহী বংশের একটা বিশেষ চিহ্ন বহন করে। আরবি ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি হচ্ছে সুলুস লিপি। একাদশ শতকে এ লিপি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পবিত্র কুরআনসহ সব ধরণের লেখায় অলঙ্করণের কাজে এলিপির  ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে।

নামফলকে আগে কুফি লিপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু সুলুস এসে তার স্থান দখল করে নেয়। তবে পাথরে খোদাই করতে গিয়ে দেখা যায় সুলুসের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকছে না। ক্যালিগ্রাফার আর খোদাইকারদের কাছে এসমস্যা বেশিদিন থাকেনি। সুলুস লিপিকে ভেঙে খোদাইকারের ছেনির ঘাত সহায়ক একটি নতুন লিপি উঠে আসে। তার নাম রাইহানী লিপি। তুর্ক আফগান ক্যালিগ্রাফার রাইহান এ লিপির আবিস্কারক। এটা সরল এবং গোলায়িত রেখার চমৎকার সমন্বিত একটি লিপি।

                                                                       বেঙ্গল তুগরা

 কিন্তু বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা এ লিপি দিয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তাদের পাললিক নমনিয়তা আর উল্লম্ব রেখার আশ্চর্য্য সম্মিলন ঘটিয়ে। বিশ্বব্যাপী সেই নতুন লিপির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস শাহী বংশের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা আবিস্কার করেন "বেঙ্গল তুগরা"। এই বেঙ্গল তুগরা সুদূর মিসরে সে সময়ের মামলুক সুলতানদেরও হৃদয় হরণ করেছিল। সুলতান হুসাইন বিন শাবান নিজেই বেঙ্গল তুগরা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করতে থাকেন।

                                                     সুলতান হুসাইন বিন শাবান-এর বেঙ্গল তুগরা

 বেঙ্গল তুগরার দিন শেষ হয়ে যায় মোগলদের চাপিয়ে দেয়া ফারসি লিপির আগ্রাসনে। শাসক বদল হয়। আরবির বদলে ফারসি রাজদরবার দখল করে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাঙলার গৌরব অস্তমিত হয়।

No comments:

Post a Comment