Monday, July 22, 2013

ইসমাইল গুলজী : ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের পথিকৃৎ

Catalog cover of Gulgee painting calligraphy

২০০৬ সালের মার্চ মাস। ঢাকায় এশিয়ান বিয়েনাল চলছে। জাদুঘরের মহাপরিচালক মাহমুদুল হক বললেন গুলজীর অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের কথা। ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ে রঙ ও রেখার যে আশ্চর্য সম্মিলন, তা তিনি নিদর্শন হিসেবে আমাদের সামনে রেখে গেছেন। গুলজীর সাথে সাক্ষাতের জন্য শিল্পকলায় গেলাম। অনুষ্ঠান শেষে হোটেল পূর্বানীতে তিনি কথা বলতে রাজি হলেন।


Ismail Gulgee and Mohammad Abdur Rahim, Hotel Purbani lobby, Dhaka, March 2006

তিনি জানালেন, ক্যালিগ্রাফি তাকে আধ্যাত্মিকতার অনুভব এনে দেয়। ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করার সময় একধরণের অলৌকিক আবেশ বোধ করেন। বিশেষ করে সোনালী-রুপালী রংয়ের ভেতর ইসলামিক ঐতিহ্য এবং একটি রাজকীয় ভাব থাকায় তার ক্যালিগ্রাফিতে রঙগুলো স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছেন।

Calligraphy Painting, Allahu Akbar

গুলজীর পেইন্টিংয়ে একটি রহস্যময়তা দর্শককে আবিষ্ট করে। যেন এর হরফগুলো নাচছে, দৃষ্টির পিপাসা ক্রমশ ঘুরে বেড়ায় পেইন্টিংজুড়ে আর সৌন্দর্যসুধা পান করে।


বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির সম্পর্কে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন, অচিরেই বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি বিশ্বের শিল্পাঙ্গনে সুনাম অর্জনে সক্ষম হবে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের একনিষ্ঠতা এবং দক্ষতার প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের কাজে নিপুনতা ও একাগ্রতা তাকে মুগ্ধ করেছে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে নবীন শিল্পীদের এগিয়ে আসার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এছাড়া ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে যেসব প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিচ্ছে তাদেরকে তিনি ধন্যবাদ জানান। পাকিস্তান সরকার ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা যেভাবে দিচ্ছে, বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারকে সেভাবে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অনুরোধ জানান তিনি।


শুধু উপমহাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ শিল্পী দেশে-বিদেশে অনেক সম্মান ও পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ছিলেন শিল্পজগতের এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক।
-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
##

সূত্র-http://calligraphybd.blogspot.com/2013/07/blog-post_15.html

 

প্রাচীন বাঙালায় ক্যালিগ্রাফি




সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হচ্ছে একটি স্বভাবগত বিষয়। সভ্যতার বিকাশের ধারায় মানুষের রুচিবোধের মাত্রার পরিবর্তন হয়। খাদ্যাভাস, পোষাক, আবহাওয়া, ভৌগলিক অবস্থান প্রভৃতি মানুষকে বৈশিষ্ট্যগত প্রভাব ও জীবনধারা চয়নে পাল্টে ফেলে। সৌন্দর্যবোধকে শুধু নিজের জন্য নয়, উত্তর-পুরুষের জন্য নিদর্শন স্বরূপ রেখে যেতে যে প্রয়াস দেখা যায়, ক্যালিগ্রাফি তার ভেতর একটি অন্যতম মাধ্যম। এটি একাধারে উন্নত রুচিবোধ এবং তথ্যের সমাহারসহ সৌন্দর্য্যের আকর হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাঙালা ভূখণ্ডের প্রাচীন নিদর্শন, বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফির যে নমুনা পাওয়া যায় তা হাজার বছরের পুরনো। গবেষকগণ প্রাচীন বাঙালা বলে যে ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করেছেন, সেটা বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা পদ্মার দক্ষিণ পাড় থেকে সুন্দরবন অঞ্চল পর্যন্ত এলাকা। বাঙালার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে, চট্টগ্রামকে বেংগাল বলে উল্লেখ করেছেন প্রাচীন ইউরোপীয় ভূগোল গবেষকরা। তবে ইসলাম পূর্ব সময়ে আরবরা সমূদ্র পথে ব্যবসায়-রুট হিসেবে বর্তমান বঙ্গোপসাগরকে বাহর আল হারাকান্দ বলে উল্লেখ করেছেন এবং সুন্দরবন অঞ্চলকে ‘বাঙালা’ বলে তাদের নথিপত্রে লিখে গেছেন।

চন্দ্ররাজাদের সময় বাঙালার ভৌগলিক সীমারেখা বৃদ্ধি পায়। তখন থেকে সমগ্র দক্ষিণ বাঙালাই 'বাঙালা' নামে অভিহিত হতে থাকে। প্রাচীনকালে বাঙালা ও বঙ্গ নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র ছিল। বাঙালাকে "বাঙালা দেশ" নামে ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গ হচ্ছে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ এলাকা। এটা ‘গৌড়’ নামেও দীর্ঘকাল পরিচিত ছিল।

বাঙালা এবং বঙ্গকে সর্বপ্রথম একত্রিত করে একক রাষ্ট্রে পরিণত করেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭ ইসায়ি)। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী রচয়িতা শামস-ই-সিরাজ আফিফ এজন্য শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে উপাধি দিয়েছিলেন 'শাহ-ই-বাঙালা', 'সুলতান-ই-বাঙালা' এবং 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান'। এই একক রাষ্ট্রের নাম হয় 'মুলুকে বাঙালাহ'। আরব বিশ্বে 'মুলুকে বাঙালাহ' একটি মর্যাদাবান, সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী এবং উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন বাঙালায় মুসলিম শাসন স্বাধীনভাবে ১৩৩৮ ইসায়ি থেকে শুরুর পর মুসলিম সমাজের ব্যাপক প্রসার হয়। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম শতক থেকেই বাঙালায় মুসলিম জনসমাজের বিস্তৃতি শুরু হয়েছে।

পাথর কিংবা পোড়ামাটিতে উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারক এবং সমসাময়িক তথ্য উন্মোচনে ফলপ্রসু মাধ্যম। বাঙালায় রাজনৈতিকভাবে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০৩ ইসায়িতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খালজির হাতে। এ সময় দিল্লীর সম্রাট ছিলেন কুতব উদ্দিন আইবেক। কিন্তু তারও বহু আগে বাঙালায় মুসলিম জনসমাজ ছিল। রাজা লক্ষণ সেনের দরবারে শেখ জালাল উদ্দিন তাবরেজী নামে একজন মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তি সভাসদ ছিলেন। লক্ষণ সেনের আরেক সভা-পণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্র রচিত 'শেখ শুভোদয়া'য় আমরা শেখ জালাল উদ্দিনের বর্ণনা দেখতে পাই। রাজসভায় একজন মুসলমান পণ্ডিত থাকার অর্থ হল রাজ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠির বিদ্যমান থাকার প্রমাণ।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বাঙালার উৎকীর্ণ লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি হচ্ছে লালমনিরহাটের হারানো মসজিদ ইস্টকলিপি। পোড়ামাটির তৈরি ইটে উৎকীর্ণ করে কালেমা তৈয়্যবা এবং ৬৯ হিজরি লেখা হয়েছে।


বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রাম। এখানেই আবিষ্কৃত ৬৯ হিজরিতে নির্মিত মসজিদটির সামনে ফসলের মাঠটি একদা ছিল চকচকার বিল। এলাকার প্রবীণ মানুষের কাছে স্থানটি আজও সাগরের ছড়া নামে পরিচিত, যার অনতিদূরে তিস্তা নদীর অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর একটি। সুতরাং এই অববাহিকায় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা বিস্ময় জাগানিয়া হলেও সেটা অস্বাভাবিক নয়। ব্রিটিশ প্রতœতাত্ত্বিক টিম স্টিল বলেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে যে প্রাচীন সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে প্রাচীন রোমান ও আরব-সভ্যতার সম্পর্ক ইতিহাসের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই আরব বণিকেরা লালমনিরহাটের ওই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করেন টিম স্টিল।

গবেষকরা ঐ ইস্টকলিপিতে তারিখের স্থলে একটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন। "সানাত ১, ৬৯" অর্থাৎ বছরের ১ম মাস(মহররম), ৬৯ হিজরি। ৬৯১ ইসায়িতে মসজিদটি নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও ইস্টকলিপির সঠিক বয়স নির্ধারণে রাসায়নিক পরীক্ষার কথা জানা যায়নি। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ্য, এর লিপি বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম শতকে যে লিপিসমূহ ছিল, বিশেষ করে ইরাক থেকে বাঙালার দিকে যে লিপি বিস্তৃতি লাভ করেছিল, তাকে 'খত আল বাহরি' বলা হয়। পরবর্তিতে একে বিহারী লিপি বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নামকরণের দুটো কারণ আমরা খুজে পাই। এক. সমূদ্রপথে এ লিপির খোদাই কারিগর ও লিপিকর বাঙালায় এসেছিলেন এবং সমূদ্রের ঢেউয়ের মত এলিপির গতিপ্রকৃতি ছিল। দুই. বাঙালার পশ্চিম-উত্তর অংশে বিহার এলাকায় পাথরে খোদাই ও পুথিপত্র রচনায় একদল ক্যালিগ্রাফার এ লিপিটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এজন্য স্থান নামের সাথে এর নামকরণ হয়েছে।

বর্তমান সময়ের ইরাকের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ইউসুফ জিন্নুনের মতে, সমুদ্র পথে এলিপির বাঙালায় আগমণ এবং উন্নতি সাধনের কারণেই একে 'খত আল বাহরি' নাম দেয়া হয়। খত আল বাহরি অর্থ- সমুদ্র লিপি।

আরেকটি বিষয় এলিপিটির আলিফের নিচের অংশ বামে একটু বেশি ঝুলানো। এ ধরণের আলিফকে বলা হয় "আলিফ মুশা'য়ার"। উৎকীর্ণ লিপিতে আলিফ মুশা'য়ার প্রয়োগ করা ইসলামের প্রথম শতকের লিপির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।

গবেষকগনের মতে, বাঙালায় কালোপাথর (ব্লাক ব্যাসল্ট) বা বেলে পাথরে (স্যান্ড স্টোন) উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফির নমুনা সমূহ সুলতানী আমল (১২০০ ইসায়ি) থেকে শুরু হয়েছে। বাঙালায় ইমারাতে ব্যবহৃত ব্লাক ব্যাসল্ট এসেছে ততকালিন বিহার এবং বর্তমানে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজমহলের কালো আগ্নেয়শিলা পাহাড় থেকে। আহমদ হাসান দানী তার মুসলিম আর্কিটেকচার ইন বেঙ্গাল গ্রন্থে লিখেছেন, মালদা জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে ব্লাক ব্যাসল্ট আনা হত এবং কদাচিৎ বিহার থেকে স্যান্ড স্টোন এবং গ্রানাইট আনা হত। এছাড়া কখনও খোরাসান থেকে ব্লাক ব্যাসল্ট আনা হত বলেও ইতিহাসে পাওয়া যায়।

প্রশ্ন হল ইস্টক লিপি উৎকীর্ণের বিষয়টির সাথে ব্লাক ব্যাসল্ট ও স্যান্ড স্টোনের সম্পর্ক কী? বাঙালার মুসলিম শাসনের আগের কোন ব্লাক ব্যাসল্ট বা স্যান্ড স্টোনের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফির উৎকীর্ণ নমুনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর থেকে প্রাচীন পোড়া মাটির ইট এবং তাতে উৎকীর্ণ লিপির নমুনা আছে।

বাঙালায় তুর্ক-আফগান শাসক এবং তাদের সাথে আগত পাথরে উৎকীর্ণ লেখা ও নকশা খোদাইয়ের দক্ষ শিল্পীরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। এজন্য সুলতানী আমল ও মোগল আমলের ইমারাতে তাদের শিল্পকর্মের বিস্তৃত নমুনা দেখা যায়।



১২০৫ থেকে ১৭০৭ ইসায়ি পর্যন্ত বাঙালায় পাথরে উৎকীর্ণ ইসলামী ক্যালিগ্রাফির সংখ্যা প্রায় ৪০০(চারশত)। সুলতানী আমলের প্রায় সবগুলি পাথরে উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফি আরবিতে এবং মোগল আমলের অধিকাংশ ফার্সিতে লেখা। এসব ক্যালিগ্রাফি মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মাজার, দরগাহ এবং কবরগাহে স্থাপন করা হয়। ক্যালিগ্রাফিতে কুরআনের আয়াত, হাদিস এবং সমসাময়িক অনেক তথ্য স্থান পায়। এটা সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চিত্র অনুধাবনে যথেষ্ট সহায়ক। এবিষয়ে এখন গবেষণাকর্মও দেখা যায়।

রাজশাহীর সুলতানগঞ্জে প্রাচীন একটি সেতুতে বাঙালার দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন ওয়াদ্দুনিয়া (আলি মর্দান খালজী, ১২১০-১২১৩ ইসায়ি) সময়ের ব্লাক ব্যাসল্টে উৎকীর্ণ ফার্সি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি ফলক পাওয়া যায়। বর্তমানে এটি বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত। এর লিপি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষক অধ্যাপক ইউসুফ সিদ্দিক বলেন, এটা তাওকি লিপি। এ প্রবন্ধ লেখকের মতে, এর খাড়া রেখা ও আনুভূমিক রেখার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে একে খত আল বাহরির স্থাপত্য সংস্করণ বললে অধিক যুক্তিযুক্ত হয়। প্রাচীন তাওকি লিপিতে শব্দের শেষ হরফের শেষাংশ বা লেজ পরবর্তী শব্দের প্রথম হরফের সাথে বিশেষ নিয়মে লেগে যায়। যেটা এ নমুনায় দেখা যায় না। অন্যদিকে আনুভূমিক রেখার শেষাংশ পুষ্ট হয়ে ঢেউয়ের মত ভাব দেখা যায় বাহরি লিপিতে। এ নমুনায় সেটা বেশ পাওয়া যায়। তিন লাইনের এ শিলালিপিতে  লাইন বিভক্তি রেখা আছে। এতে জমিন খোদাই এবং হরফ উচু রাখা হয়েছে।

কালো পাথরে পলিশ(পৃষ্ঠদেশ মসৃণ করার পদ্ধতি) করলে কালো চকচকে ভাব আসে। এর ওপর খোদাই করলে, খোদাই অংশ ছাই রঙের সাদাটে ভাব হয়। হরফ খোদাই করলে অল্প সময়ের মধ্যে একটি নামফলক তৈরি করা যায়। কিন্তু সুলতানী আমলের প্রায় সবগুলো এবং মোগল আমলের অধিকাংশ পাথরে জমিন খোদাই করা হয়েছে, ফলে হরফ এবং বিভক্তি রেখা জমিন থেকে উচু হয়েছে। এটা বলা যত সহজ, হাতে করা ততটাই কঠিন। এ বিষয়টি চিন্তা করলে দক্ষতার উচ্চমান অনুধাবন করা যায়। পাথর খোদাই কাজ দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। প্রথমে একজন ক্যালিগ্রাফার পুরো লেখাটি(টেক্সট) পাথরে কালি বা সিসার কলম দিয়ে একে দেন, তারপর উস্তাদ খোদাইকার ছেনি (খোদাই করা লোহার ছোট বাটালি ধরণের যন্ত্র) দিয়ে হরফের আউট লাইন বের করে দেন, একে কাটাই বলে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হরফের আউটলাইন ধরে জমিনকে ৫ থেকে ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত খোদাই করে একজন সাগরেদ বা নবিশ খোদাইকার। একে চটানো বলে। খোদাই কাজে ওস্তাদ খোদাইকারের ওপরই ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যের মান রক্ষার দায়িত্ব বর্তায়। আর এটা দু'এক বছরে অর্জন করা সম্ভব নয়। বাঙালার সুলতানী আমলের মাঝামাঝি সময় থেকে খোদাই দক্ষতা অসাধারণ পর্যায় পৌছেছিল। কিছু কিছু নমুনায় যিনি টেক্সট একেছেন তিনিই খোদাই করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

পশ্চিম বঙ্গের বিরভুমের সিয়ানে একটি খানকায় সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওদ খালজীর (১২২১ ইসায়ি) সময়ের একটি নামফলক পাওয়া গেছে। যেটার লিপিশৈলিতে তেমন পার্থক্য নেই সুলতানগঞ্জের শিলালিপি থেকে।



রাজশাহীর নওহাটায় একটি অজ্ঞাতনামা মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে বিদ্রোহী খালজী সেনা নায়ক বলাকা খানের (১২২৯-১২৩০ ইসায়ি) সময়ের একটি শিলালিপি উদ্ধার করা হয়। বরেন্দ্র জাদুঘরে বর্তমানে সেটি সংরক্ষিত। লিপির ভাষা ফারসি। লিপি শৈলি সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোন মন্তব্য কেউ করেননি, তাওকি ও সুলুস লিপির মিশ্রন বলে অনেকে মত দিয়েছেন। এ প্রবন্ধ লেখকের মতে, পূর্বের শিলালিপি দুটি থেকে এর বিশেষ পার্থক্য হচ্ছে, উৎকীর্ণ বাহরি লিপির এটি একটি বলিষ্ঠ নমুনা। আলিফ মুশা'য়ার এবং আলিফ মুরাক্কাব বা আলিফ নেহাইয়্যাহ(হরফের সাথে মিলিত আলিফ)সহ ত্বয়া, কাফ, লামের আলিফের(খাড়া রেখা) মাথায় ডানদিকে নিশানাকৃতির জুলফ(আকশির মত তিনকোনা পতাকা) বিজয় অনুভব এবং আনুভূমিক হরফের শেষ প্রান্ত বাহরি লিপির পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। এতেও জমিন খোদাই(রিভার্স খোদাই) করা হয়েছে। আয়তাকার প্যানেলের এধরণের কাজ তুর্কি ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ শিলালিপির ক্যালিগ্রাফার এবং খোদাইকার তুর্কি বংশোদ্ভুত বা ঐ ধারার কাজ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল বলে অনুমান করা যায়। এ শিলালিপির মিম মুরাক্কাব আউয়াল(মিলিত প্রথম মিম) মাথার শুরু এবং শেষ সংযুক্ত নয়। জিমের  মাথার(র'স) প্রথমাংশ বৃত্তাকার ও ভারি। কাফ মুরাক্কাবের আলিফের পেট বা বুক বরাবর ডানপাশে আল সুওবানি(অজগরাকৃতি রেখা) শিলালিপিটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এ তিনটি শিলালিপির আলোচনা থেকে খালজী শাসনামলের (১২০৩-১২৩০) ক্যালিগ্রাফির শৈলি বিষয়ক একটি চিত্র পাওয়া যায়। স্থাপত্যে বাহরি লিপির প্রয়োগ এবং এর দ্রুত উন্নয়নে ক্যালিগ্রাফার ও খোদাইকারের আন্তরিকতা এবং নিপুনতা অর্জনে একনিষ্ঠতা প্রশংসনীয়।

ইলিয়াসশাহী (১৩৪২-১৪৮৭ ইসায়ি) শিলালিপিতে খাটি আরবি শৈলিতে ফিরে যাওয়ার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সুলুস লিপির অসাধারণ প্রয়োগ হয়েছে এসময়। হাদরাত পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ক্যালিগ্রাফি (১৩৭৪ ইসায়ি) সুলুস লিপির অন্যতম সেরা উদাহরণ। মিহরাবে, দেয়ালে ক্যালিগ্রাফির সাথে ফুলেল অলংকরণের ব্যবহার আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে একে। মিহরাবে উৎকীর্ণ সুলুস লিপিটির নান্দনিক রূপ-সৌন্দর্য সমসাময়িক তুর্কি সুলুস লিপির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। তবে মসজিদের অন্য দেয়ালে উৎকীর্ণ সুলুস লিপিতে বেশ পার্থক্য আছে। এতে ধারণা হয়, মসজিদটিতে একাধিক ক্যালিগ্রাফার কাজ করেছেন। মসজিদে মহিলা নামাজীদের প্রবেশদ্বারের উপরে কালিমা তৈয়্যবার সুলুস শৈলির কম্পোজিশনটি বাঙালায় মধ্যযুগের উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফির অন্যতম সেরা কাজ।

অন্যদিকে নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গাজীপীরের মাজার থেকে প্রাপ্ত শিলালিপিটি সুলুস শৈলি ভেঙ্গে তুগরায় রূপান্তর বলা যায়। খাড়া হরফের মাথাগুলো মোটা আর ভারি। বাশের বেড়ার মত হরফের খাড়া রেখার বুক ও পেট বরাবর কাফ হরফের সুওবান আর ফি, নুন দিয়ে বন্ধন সৃষ্টি। নিচে হরফের কম্পোজিশন দিওয়ানী লিপির তলোয়ার কম্পোজিশন সদৃশ করা হয়েছে। এটা তুর্কি ধারার বাঙালা সংস্করণ বলা যায়। এধরণের কাজ থেকে বেংগল তুগরার স্বকীয় ধারা বিকশিত হয়। সুলতান আহমদ শাহ(১৪৩২-১৪৪১ ইসায়ি) সময়ের শিলালিপি এটি।

গৌড়ের চান্দ দরওয়াজা শিলালিপিটি বারবাক শাহের(১৪৬৬-১৪৬৭ ইসায়ি) সময়ের। তুগরার অসাধারণ একটি নমুনা এটি। খাড়া আয়তন বিশিষ্ট দুই সারি ঘরগুলোতে চমৎকার তুগরা করা হয়েছে। চারপাশে বর্ডারে সুলুস লিপি এবং শামসি (সূর্য) সদৃশ ফুল দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে। এটি সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফির একটি সেরা কাজ।

সুলতানী আমলের শেষদিকে মাহমুদ শাহের (১৫৩৪-১৫৩৫ ইসায়ি) সময়ের একটি অজ্ঞাতনামা শিলালিপির ছবিতে দেখা যায় সুলুস লিপিকে চমৎকার করে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এসময় পোড়া মাটির ফলকে সুলুস লিপির কিছু কাজ হয়েছে। সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফি ছিল পরিপূর্ণ আরবি লিপি শৈলিতে প্রত্যাবর্তনের একটা প্রচেষ্টা। এসময়ে ভাষাগত বিষয়টি ফারসীর পাশাপাশি আরবির প্রতি বিশেষ টান পরিলক্ষিত হয়। সুলতানি আমলে প্রচুর মসজিদ ও মাদ্রাসা একসাথে গড়ে ওঠে এবং বিশুদ্ধ আরবি চর্চার দিকে মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। সুলুস লিপি হচ্ছে আরবি লিপিশৈলির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং নান্দনিক শৈলি। বাঙালার স্বাধীন সুলতানগণ যথার্থই ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যবোধের সমঝদার ছিলেন এবং সেরা শৈলিটিরই প্রসার ও উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।

মোগল শাসকরা (১৫৭৬-১৭৫৭ ইসায়ী) শিয়া প্রভাবিত ছিলেন। ফারসি ভাষার মত ফার্সি লিপি নাস্তালিক লিপির প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিল প্রায় প্রশ্নাতীত। এজন্য সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফার ও খোদাইকারদের একটি বৃহদাংশ বিপাকে পড়েন। এসময় বাঙালার উৎকীর্ণ লিপিতে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা দেখা যায়। সামান্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া আরবি মিশ্রিত ফারসি শিলালিপিতে সৌন্দর্য বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে কিছুকালের মধ্যে ইরান থেকে লিপি শিল্পী ও খোদাইকারদের বাঙালায় আগমন ঘটে এবং নাস্তালিক লিপি দিয়ে চমৎকার সব নামফলক তৈরি হতে থাকে। নামফলকে কুরআন-হাদিসের বাণী বাদ দিয়ে ফার্সি কবিতার ছত্র জায়গা করে নেয়। মাজারগুলো পুজার আখড়ায় পরিণত হয়। নানা নামে-বেনামে অসংখ্য পীর-আওলিয়ার মাজারের উদ্ভব ও ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগলরা বাঙালায় শাসন ক্ষমতা দখল করে ইসলামী আকিদা ও তমুদ্দুনের তরীটি ডুবিয়ে দেয়। আরবি ক্যালিগ্রাফির জৌলুস নিভিয়ে ফার্সি ক্যালিগ্রাফির নিশান উড়ায়।

ফার্সি ক্যালিগ্রাফারদের 'শিরিন দাস্ত' 'জরীন দাস্ত' উপাধী আর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। এসময় গুলজারের মত কিছু ফার্সি লিপি বাঙালায় ছড়িয়ে পড়ে। কুরআন লেখায়ও এর বেশ প্রভাব পড়ে। ইরানী নাশখ লিপিতে অনেক কুরআনের কপি করা হয়। মোগল আমলের নামকরা কিছু ক্যালিগ্রাফারের উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া গেলেও সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফারদের প্রায় সবাই ইতিহাস থেকে নিচিহ্ন হয়ে গেছেন।

বাঙালার প্রাচীন ক্যালিগ্রাফির লিপিকর, খোদাইকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখন পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফির নমুনা পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে এর শৈল্পিক মূল্যায়ন হতে পারে। এটা করা সম্ভব হলে সমসাময়িক শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এবং এর ঐতিহ্যধারার পথ বের করা সহজ হবে।


বিশ্বে ইসলামী স্থাপত্যকলায় বাঙালার যে বিশাল অবদান, বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফিতে, তা ব্যাপকভাবে গবেষণার দাবি রাখে। -মোহাম্মদআবদুর রহীম
##

 সূত্র- http://calligraphybd.blogspot.com/2013/07/blog-post.html

Thursday, June 27, 2013

সাত্তার মসজিদ : অনিন্দ্য সুন্দর ক্যালিগ্রাফির উপমা

Sattar Mosque, North-East Elevation, Bhangnahati, Sripur, Gazipur, Bangladesh. Photo taken 23 June 2013.


সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মসজিদে ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অলঙ্করণ শিল্পীত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। পাথরে, কাঠে, টাইলস এমনকি প্লাস্টার কাটাই মাধ্যমে তা আন্তর্জাতিক মানের বলে গবেষকগণ বলছেন।

এমনই একটি মসজিদ ঢাকার অদূরে গাজীপুরের শ্রীপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণ এবং অলঙ্করণকাজ শেষ হলে একটি অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।


North Elevation, Main Part,  23-6-2013


২০১২ সালে নির্মাণ শুরু হওয়া এই মসজিদটি প্রায় পুরোটা মার্বেল পাথর দিয়ে করা হচ্ছে। ভেতরের অলঙ্করণ বিশুদ্ধ ইসলামী শিল্পকলার মটিফ এবং পাথরের ওপর কালো মার্বেল পাথরের হরফ ইনলে পদ্ধতিতে ক্যালিগ্রাফি করা হচ্ছে। এধরণের মার্বেল ইনলে ক্যালিগ্রাফি বাংলাদেশে প্রথম কাজ। অসাধারণ লিপিশৈলী এবং সৌন্দর্য সুষমা এতে প্রয়োগ করা হয়েছে। সুলুস লিপির এধরণের শিল্পকর্ম বাংলাদেশে বিরল।


Sura Tagaboon :1-4, Thuluth Style, Inlay on Marble


বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ মোহাম্মদ আবদুর রহীম এবং তুরস্কের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মোজাফ্ফর আহমদ যৌথভাবে এ মসজিদের ক্যালিগ্রাফি করেছেন। অলঙ্করণের যাবতীয় নকশা করেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহীম। এর স্থাপত্য নকশা করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা স্থাপত্যবিদ কে এম মাহফুজুল হক জগলুল।


South Elevation, Sahn Corridor, 23-62013


উত্তরার  শপ এন শেভ স্বত্ত্বাধীকারী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার এ মসজিদটির নির্মাণ ব্যয়ভার বহন করেছেন।

Inside Main Prayer Hall Ceiling, Plaster work, 23-6-2013

একটি ট্রেডিশনাল(খত) ক্যালিগ্রাফি

আইসেসকো ইসলামিক কালচারাল রাজধানী'২০১৩ হিসেবে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মদিনা মুনাওরাকে ঘোষণা দিয়েছে। এ উপলক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে ক্যালিগ্রাফারদের চোখে মদিনা মুনাওরা শীর্ষক প্রতিযোগিতা হয়। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই এতে ক্যালিগ্রাফি ফটোগ্রাফ পাঠান। মোহাম্মদ আবদুর রহীম একটি ট্রেডিশনাল(খত) এবং একটি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ফটোগ্রাফ পাঠিয়েছিলেন।

Innal iman la yarizhu ila al-madina kama tarizhu al haiyatu ila juriha

Sunday, July 15, 2012

ক্যালিগ্রাফি : আধ্যাত্মিক রেখাঙ্কন





[কালিমা তৈয়্যবা, ক্যানভাসে এক্রিলিক, শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম]

শিল্পকলার জগতে 'স্পিরিচ্যুয়াল জিওমেট্রি' বা আধ্যাত্মিক রেখাঙ্কন বলে যে কথাটি প্রচলিত রয়েছে, তা ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আক্ষরিক অর্থে সুন্দর হস্তাক্ষর দিয়ে গড়া নান্দনিক লিপিকলাকে ক্যালিগ্রাফি বলে। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হাজার বছর পেরিয়ে এর সৌন্দর্য, স্পষ্টতা ও শৈল্পিক অভিব্যক্তির কারণে শিল্পকলায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামী ক্যালিগ্রাফির যাবতীয় অর্জনের পেছনে মূল প্রেরণা হচ্ছে পবিত্র কুরআন। কুরআনের বাণীকে শত শত বছর ধরে শিল্পীরা হৃদয়ের সুষমা দিয়ে প্রকাশ করেছেন।


[টাইলস এনগ্রেভ ক্যালিগ্রাফি, শিল্পী আমিনুল ইসলাম আমিন]

ললিতকলায় ফিগারেটিভ বা জীবাকৃতির বিষয়টি ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা সযতনে এড়িয়ে গেছেন বিশ্বাসগত কারণে। এ জন্য শিল্পকলায় একটি অসীম সম্ভাবনার ভিন্ন আঙ্গিকের ক্ষেত্র প্রকাশিত এবং প্রসারিত হয়েছে। শিল্পের যাবতীয় অনুসঙ্গ এতে রয়েছে আর এতে প্রতিনিয়ত প্রতিসাম্য, ফুলেল নক্সাকলা এবং জ্যামিতিক-গাণিতিক বিষয়াবলীকে শিল্পের ধারায় তুলে ধরা হয়েছে। ক্যালিগ্রাফির হরফের গতি প্রকৃতিতে যে অন্তরাগত সৌন্দর্য প্রয়োগ করা হয়, তা শেষ র্পযন্ত আধ্যাত্মিক রেখাঙ্কন হিসেবে দর্শককে মুগ্ধ করে।
সাম্প্রতিক ঢাকায় ক্যালিগ্রাফির দুটি বড় প্রদর্শনী আয়োজন হয়েছে। মইনিয়া ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন ৯ জুন ২০১২ ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা এবং ১২-২০ জুন জাতীয় জাদুঘরে ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এতে দেশের অর্ধশতাধিক শিল্পী অংশ নেন। অসাধারণ মনমুগ্ধকর এ প্রদর্শনী দর্শকদের মোহিত করে।


[আইসেসকো'র ডিরেক্টর জেনারেলকে ক্যালিগ্রাফির পরিচিতি দিচ্ছেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম]

১৪ জুলাই ২০১২ শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারীতে ৩২ শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকাকে ২০১২ সালের এশিয় অঞ্চলের রাজধানী উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীতে আইসেসকো'র ডিরেক্টর জেনারেল ড. আবদুল আজিজ ওসমান আলতুআইজরি শিল্পকর্ম আগ্রহ নিয়ে দেখেন এবং শিল্পমানে অতুলনীয় বলে মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশে এ নবধারার শিল্পমাধ্যমটি জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। প্রদর্শনীতে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতি এবং তাদের সপ্রশংস মন্তব্য দেখে তা ধারণা করা যায়।


[ইসলামী নক্সাকলা]

গত দু'দশকে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির জাগরণে কয়েকজন শিল্পীর নিরলস প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতা রয়েছে। শিল্পী মুর্তজা বশীর 'ক্যালিমা তৈয়্যবা' নামে একটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেন গত দশকের শেষ দিকে। এরপর প্রায় প্রতিবছর অব্যাহত রয়েছে এ শিল্পের প্রদর্শনী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মন্ডল, আরিফুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুর রহীম এ অঙ্গনকে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ক্যালিগ্রাফিতে পেইন্টিং ধারাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এর ট্রেডিশনাল ধারাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে মোহাম্মদ আবদুর রহীমের অবদান বলা যায় সবচেয়ে বেশি। তিনি ক্যালিগ্রাফি অঙ্গনে নতুন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী তৈরিতে বটবৃক্ষের মত কাজ করে চলেছেন। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা খোলাশা হবে, শিল্পকলার বর্তমান প্রদর্শনীর ৩২ শিল্পীর ১৬ জনই মোহাম্মদ আবদুর রহীমের ছাত্র। এ ছাত্রদের অনেকেই আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে সুনাম কুড়িয়েছে।


[আলজেরিয়ায় ক্যালিগ্রাফি ফেস্টিভ্যালে মোহাম্মদ আবদুর রহীম]

ওস্তাদ আবদুর রহীম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ্যাওয়ার্ড অর্জন ও ইরানে একটি ইন্টারন্যাশনাল ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বিচারক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আলজেরিয়া সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি ফেস্টিভালে অংশগ্রহন ও ওয়ার্কশপে ড্রেমনেস্টর হিসেবে বক্তৃতা দেন।

বাংলাদেশে এ শিল্পধারাটি জনমনে প্রবল আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

সূত্র-
http://www.rahimcalligraphybd.blogspot.com/

Thursday, March 22, 2012

সুলতানী আমলের শিলালিপির রূপ উন্মোচন


মোহাম্মদ আবদুর রহীম

শিলালিপি নিয়ে তেমন গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। মার্বেল পাথরের ওপর হরফ অঙ্কন এবং তা খোদাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকলেও প্রাচীন শিলালিপি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনি। একবার ঢাকার কেরানিগঞ্জের এক প্রাচীন মসজিদের কালো পাথরের(ব্লাক ব্যাসল্ট) ওপর লেখা কপি করার জন্য আমাকে দেয়া হয়েছিল। সেটা ছিল ফারসি লিপি। হুবহু কপি করার জন্য মধ্যযুগের ফারসি লিপি নিয়ে তখন আমি কিছুদিন আদাজল খেয়ে চর্চা করেছিলাম।

জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত যেসব শিলালিপি দেখেছি। তার অধিকাংশ কালোপাথরের। আর এসব পাথরে কিভাবে লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছে, লিপির শৈল্পিক মান, সমসাময়িক লিপিকার, খোদাইকার বিষয়ে কৌতুহল বেড়েছে। এবিষয়ে খোজখবর নিতে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উকি দিয়েছে মনে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাচীন শিলালিপির একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে চুরাশিটি ছবি ছিল। প্রদর্শনীর আয়োজক ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি প্রায় দুই শতাধিক শিলালিপি খুঁজে পেয়েছেন শুধুমাত্র ঢাকাতে। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য শিলালিপির সন্ধান মিলেছে। এর প্রায় সবগুলোই সুলতানী এবং মোগল আমলের। এত বিপুল সংখ্যক শিলালিপির লিপি হচ্ছে আরবি এবং ফারসি। আর এগুলো সবই ধর্মীয় ইমারতের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সুলতানি আমলের গুলো আরবিতে এবং মোগল আমলের গুলো ফারসিতে কেন লেখা হলো? এগুলো প্রায় সবই ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক। এখন যেমন নামফলক বাঙলা এবং ইংরেজিতে লেখা হয়। আমি ঢাকাতে জাপানি এবং চীনা মান্দারিন ভাষায়ও নামফলক করে দিয়েছি। আর আরবি, উর্দু, ফারসী এবং আরবি ক্যালিগ্রাফিতে হরদম করছি। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে যিনি নামফলকটি তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন, তার ইচ্ছে অনুযায়ী তা করা হয়। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে। যখন যে নামফলক লাগানো হয়, তা পড়ার লোকজনেরও তখন অভাব ছিল না।

নামফলক সমসাময়িক পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের জীবনমান ও শিল্পবোধের আয়না স্বরূপ। নামফলকের উপাদান যেমন- পাথর, বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন মানের ও দামের পাথর পাওয়া যায়। সাদা মার্বেল 'কারারা' সাধারণত লেখার কাজে বেশি ব্যবহার হয়। এটা পর্তুগাল ও ইতালি থেকে আসে। আর পাকিস্তান ও ভারত থেকেও মার্বেল আসে, তা নিম্নমানের। কিছুদিন পর সাদা পাথর লালচে রঙ ধারণ করে খোদাই নষ্ট হয়ে যায়। সাদা পাথরে সাধারণত হরফ খোদাই করা হয়।

কালো পাথর কদাচিত এখন লেখার কাজে ব্যবহার হয়। এটাতে লেখা সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য এবং খরচ বেশি। এতে হরফ খোদাই না করে জমিন খোদাই করা হয়। এজন্য দক্ষ ও নিপুন হাতের কারিগর ছাড়া তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।




গত ১৯ মার্চ ২০১২ দৈনিক সংগ্রাম ২১ পৃষ্ঠায় মুহাম্মাদ আবদুল কাদির-এর "বাবুবাজার জামে মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপির প্রাপ্ত অংশসহ লিপিটির পূর্ণ পাঠ উদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা" শিরনামে লেখাটি পড়ে এ ব্যাপারে আরো জানার আগ্রহ হল। বাবুবাজার জামে মসজিদের তৃতীয় তলায় রক্ষিত কালো পাথরটি সরজমিন দেখে মনে হল, পাঠোদ্ধার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর লিখন কৌশল, লিপির শৈলিমান এবং ততকালিন এই লিপিশিল্পের দক্ষতা ও নিপুনতা নিয়ে আলোচনাও গুরুত্বের দাবিদার।

আবদুল কাদিরকে ধন্যবাদ। তিনি যে "পাঠ" তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তা সঠিক বলে মনে করি। ক্যালিগ্রাফি বিদ্যায় আরবি লিপিতে তিনটি হরফ যথা-আলিফ, বা, নুন হচ্ছে মূল হরফ। অধিকাংশ হরফ এ তিনটি হরফের সমন্বয়ে গঠিত।
আলিফ হরফটি ত্বোয়া, যোয়া, কাফ এবং লাম হরফে আছে। এছাড়া লাম-আলিফ একত্রে লিখতে আলিফকে একটু হেলানো হয়। একে আলিফ মায়েলা বলে।





                                               মিলিয়ে দেখার জন্য লেখকের নিজের লেখা নমুনা


আবদুল কাদির তার লেখায় শিলালিপির দ্বিতীয় ছত্রে ফা হরফের আগে এগারোটি আলিফের কথা বলেছেন এবং সম্ভাব্য শব্দ উল্লেখ করেছেন। আমি একজন ক্যালিগ্রাফার হিসেবে তার উল্লেখকৃত শব্দ লিখে মিলিয়েছি এবং কম্পোজিশন নিয়মে তা হুবহু মিলে যায়। সুতরাং তার "পাঠ" ব্যাকরণগত এবং ক্যালিগ্রাফির নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ। এছাড়া তিনি ইতিহাস এবং পাঠোদ্ধার বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন। তা নবীন গবেষকদের কাজে লাগবে।

এই শিলালিপিটির একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটি বাঙলার স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহী বংশের একটা বিশেষ চিহ্ন বহন করে। আরবি ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি হচ্ছে সুলুস লিপি। একাদশ শতকে এ লিপি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পবিত্র কুরআনসহ সব ধরণের লেখায় অলঙ্করণের কাজে এলিপির  ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে।

নামফলকে আগে কুফি লিপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু সুলুস এসে তার স্থান দখল করে নেয়। তবে পাথরে খোদাই করতে গিয়ে দেখা যায় সুলুসের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকছে না। ক্যালিগ্রাফার আর খোদাইকারদের কাছে এসমস্যা বেশিদিন থাকেনি। সুলুস লিপিকে ভেঙে খোদাইকারের ছেনির ঘাত সহায়ক একটি নতুন লিপি উঠে আসে। তার নাম রাইহানী লিপি। তুর্ক আফগান ক্যালিগ্রাফার রাইহান এ লিপির আবিস্কারক। এটা সরল এবং গোলায়িত রেখার চমৎকার সমন্বিত একটি লিপি।

                                                                       বেঙ্গল তুগরা

 কিন্তু বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা এ লিপি দিয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তাদের পাললিক নমনিয়তা আর উল্লম্ব রেখার আশ্চর্য্য সম্মিলন ঘটিয়ে। বিশ্বব্যাপী সেই নতুন লিপির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস শাহী বংশের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা আবিস্কার করেন "বেঙ্গল তুগরা"। এই বেঙ্গল তুগরা সুদূর মিসরে সে সময়ের মামলুক সুলতানদেরও হৃদয় হরণ করেছিল। সুলতান হুসাইন বিন শাবান নিজেই বেঙ্গল তুগরা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করতে থাকেন।

                                                     সুলতান হুসাইন বিন শাবান-এর বেঙ্গল তুগরা

 বেঙ্গল তুগরার দিন শেষ হয়ে যায় মোগলদের চাপিয়ে দেয়া ফারসি লিপির আগ্রাসনে। শাসক বদল হয়। আরবির বদলে ফারসি রাজদরবার দখল করে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাঙলার গৌরব অস্তমিত হয়।

Friday, March 9, 2012

বাঙলা ক্যালিগ্রাফি : ভিন্ন এক শিল্প আলেখ্য

ব্লগারের প্রোফাইল ছবি





বাঙলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা এ ভাষার প্রথম পথচলা থেকে শুরু হয়েছে। শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে। প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে।



ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে। কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের। আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্রেডিশন দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন দু'একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শুণ্যের কোঠায়।



বাঙলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে। এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন, দুই. লিপিকলা।



বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক। তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে। এ ধারায় যারা কাজ করেছেন তারা প্রায় সবাই চারুকলার।



প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায়। তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্যদের মাঝে দেখা যায় না।



আর বাঙলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে।



হাতে লেখা সাইনবোর্ড ও দেয়াল লিখন :

এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না। দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাঙলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হত। হরফে আলোছায়া আর উচুনিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোয়া ছিল অসাধারণ। তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করত।



একুশে উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনারের আশেপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মান সম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত। চারুকলার ছাত্ররা বরারবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত। এখন আর সেই মান নেই।



এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া মহল্লায়ও বের করা হত। এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে। এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল। আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালবাসা দূরে থাক যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে।




 উল্টো চিত্র:

এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে। বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। পেইন্টিংয়ে হাশেমখান, কাইয়ুম চৌধুরী আর আবদুস সাত্তার বাঙলা হরফকে অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে।





অন্যদিকে বলা যায় একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ্য করা যায়।









এসব বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায়। তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোন ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাঙলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন।

আরহামের পিকটোগ্রাফি:



আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেচিয়ে বাকিয়ে যেকোন বস্তু বা প্রাণীর চিত্র একেছেন। তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে সাচ্ছন্দ্যরূপে। ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে। এধরণের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।

এই হচ্ছে চলমান বাঙলা ক্যালিগ্রাফির চিত্রালেখ্য।


ছবি- নেট ও আমার সংগ্রহশালা থেকে।